ঈসা মসীহ্‌ কি শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন?

দুটি আয়াত দিয়ে ঈসা-বিরোধী সমালোচকেরা বলেন যে হযরত ঈসা শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য। অবশ্য, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ক্ষেত্রে এই কথা হয়ত বলা যায়, কারন কোরআন শরীফে লেখা আছে:

“এমনি ভাবে আমি আপনার প্রতি [মুহাম্মদ] আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশ-পাশের লোকদের সতর্ক করেন” (সুরা আশ-শুরা ৪২:৭)

কিন্তু ইঞ্জিল শরীফের পুরো সাক্ষ্য দেখলে বোঝা যায় যে ঈসা মসীহ্ প্রথমত ইহুদীদের কাছে গেলেন কিন্তু তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য। কিন্তু প্রথমে আমরা সেই দুই ভুলব্যাখ্যাকৃত আয়াত দেখব:

মথি ১০:৫—“এই আয়াত অনুযায়ী ঈসা মসীহ্‌ শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন”

মথি ১০ অধ্যায়ে ঈসা মসীহ্ তার সাহাবীদের পাঠিয়েছিলেন একটি বিশেষ সময়ের জন্য, এবার শুধু ইহুদীদের কাছে। এই যাত্রার নিয়ম নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য দেওয়া হল, কারণ ইঞ্জিলে এই যাত্রার সমাপ্তির বর্ণনা আছে (লূক ৯), এবং পরে ঈসা মসীহ্ এই যাত্রার কিছু নিয়ম পরিবর্তন করেছিলেন (লূক ২২:৩৫-৩৬)।

মথি ১৫:২১-২৮—“এই আয়াত অনুযায়ী ঈসা মসীহ্‌ শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন

মথি ১৫:২১-২৮ (এবং মার্ক ৭:২৩-৩০) অনুচ্ছেদে ঈসা মসীহ্ একজন কেনানীয় মহিলাকে বোঝাছিলেন যে তার তবলিগ কাজ প্রথমত বনি-ইসরাইলদের কাছে।

এই দুই আয়াতের দশগুণ বেশী আয়াত ইঞ্জিলে পাওয়া যায় যেখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে মসীহ্র বাণী সমস্ত জাতির জন্য, এমনকি তৌরাত, জবুর ও নবীদের কিতাবেও এমন কথা আছে। অবশ্য তার দুনিয়াবি প্রচার-কাজ প্রথমত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ছিল, কারণ হযরত ইবরাহিমের সময় থেকেই এই ইসরাইল জাতি ছিল আল্লাহ্‌র বাণীর হাতিয়ার। এইজন্য ঈসা মসীহ্ বনি-ইসরাইলীয়দের মধ্যে প্রচার করেছিলেন।

কিন্তু ঈসা মসীহ্র ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থিত হওয়ার পরপরেই নতুন একটি যুগ শুরু হল, আল্লাহ্ ও মানবজাতির মধ্যে নতুন একটি চুক্তি বা ব্যবস্থা ঈসা বহাল করেছিলেন। আগে জাতিরা ইসরাইলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে জানতে পারত, কিন্তু তখন থেকে সরাসরি ঈসা মসীহ্র মাধ্যমে সমস্ত জাতি আল্লাহ্‌র কাছে আসতে পারে। ঈসার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগেও ঈসা বলেছিলেন:

“আমিই দুনিয়ার নূর।” (ইউহোন্না ৮:১২)

“আমিই পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারে না।” (ইউহোন্না ১৪:৬)

ঈসা বলেছিলেন যে তার আত্ম-উৎসর্গ হবে:

“মানুষ যেন জীবন পায় সেইজন্য আমি আমার এই শরীর দেব।” (ইউহোন্না ৬:৫১)

এবং মসীহ্র বিষয় একটি ভবিষ্যদ্বানী মথি উল্লেখ করেছিলেন যে:

“তাঁরই উপর অ-ইহুদীরা আশা রাখবে।” (মথি ১২:২১)

যখন ইমাম শামাউন ঈসাকে বাইতুল মোকাদ্দসে ঈসাকে দেখতে পেলেন তিনি বললেন:

“আমার চোখ তোমার নাজাতের ব্যবস্থা দেখেছে…অন্য জাতির কাছে এটা পথ দেখাবার নূর” (লূক ২:৩১-৩২)

তার ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থানের পরে, ঈসা মসীহ্ সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য:

এইজন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর। পিতা, পুত্র ও পাক-রূহের নামে তাদের তরিকাবন্দী দাও। আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিয়েছি তা পালন করতে তাদের শিক্ষা দাও। দেখ, যুগের শেষ পর্যন্ত সব সময় আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি।” (মথি ১৮:১৯-২০)

লূকে সাহাবীদের কাছে ঈসা একই রকম হুকুম দিয়েছিলেন:

“জেরুজালেম থেকে শুরু করে সমস্ত জাতির কাছে মসীহের নামে এই খবর তবলিগ করা হবে যে, তওবা করলে গুনাহের মাফ পাওয়া যায়। তোমরাই এই সমস্ত বিষয়ের সাক্ষী।” (লূক ২৪:৪৬-৪৮)

এবং প্রেরিত কিতাবে তিনি সাহাবীদের হুকুম দিলেন:

তিনি তাদের বললেন, “জেরুজালেম, সারা এহুদিয়া ও সামেরিয়া প্রদেশে এবং দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত তোমরা আমার সাক্ষী হবে।” (প্রেরিত ১:৮)

একজন ব্যক্তির শেষ বাণীর উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়—এটাই ছিল ঈসা মসীহ্র শেষ হুকুম।

এর পরেও আগেকার কিতাবের বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বানীতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে মসীহ্ সমস্ত জাতির জন্য ছিল। নবী ইশাইয়া লিখেছিলেন যে:

“সেই দিন ইয়াসিরের মূল সব জাতির জন্য নিশানের মত হয়ে দাঁড়াবেন; সব জাতি তাঁর কাছে জমায়েত হবে” (ইশাইয়া ১১:১০)

এবং

“দূরের লোকেরা তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে।” (ইশাইয়া ৪২:৪)

তেমনই ভাবে দানিয়েল নবী তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে:

সেই ইবনে আদমকে কর্তৃত্ব, সম্মান ও রাজত্ব করবার ক্ষমতা দেওয়া হল যেন সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা তাঁর সেবা করে। তাঁর রাজত্ব চিরস্থায়ী; তা শেষ হবে না আর তাঁর রাজ্য কখনও ধ্বংস হবে না। (দানিয়েল ৭:১৪)

ঈসা মসীহ্র বারজন সাহাবী মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জাতির কাছে মসীহ্র বাণী প্রচার করতে লাগলেন। তারা তো ঈসার শিক্ষা খুব ভালভাবে জানতেন। যদি ঈসা ‘কেবল ইহুদীদের জন্য’ হতেন, তাহলে তারা কেন জাতির কাছে তার বাণী প্রচার করতে করতে তাদের সারা জীবন নষ্ট করতেন কেন?

অনেকের ভুল ধারণা আছে যে ‘এক একটা নবী এক একটা জাতির জন্য আসলেন’, কিন্তু সেটা ইতিহাসের সাথে মিলে না। প্রায় সব নবীগণ—হযরত আদম, নূহ্, ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, মূসা, দাউদ, সোলায়মান, ইউনুস, ইলিয়াস, আল-ইয়াসা, জাকারিয়া, ইয়াহিয়া, এবং ঈসা সবই এক বংশধরে ছিল, ইয়াকুবের সময় থেকে যাকে বলা হয় “বনি-ইসরাইল”। আল্লাহ্ এই জাতিকে বেছে নিয়েছিলেন তার “আদর্শ সমাজ” হওয়ার জন্য, এবং তাদেরকে রাখলেন তিন মহাদেশের কেন্দ্রস্থলে। ঈসা মসীহ্ আগেকার নবীদের মত বনি-ইসরাইলদের কাছে প্রথমে আসলেন, কিন্তু পরে তিনি প্রকাশ করলেন যে তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য হবে।

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *