খৃষ্টান ধর্মের পাপমোচন বিশ্বাস

খৃষ্টান ধর্মের পাপমোচন বিশ্বাস ও তার অসারতার প্রমাণ ৷

ধারণাঃ– খৃষ্টানধর্মের অন্যতম একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিশ্বাস হলো, প্রায়শ্চিত্তে বিশ্বাস বা পাপ মোচন বিশ্বাস এই বিশ্বাসটাকে খৃষ্টান ধর্মের প্রাণ বলা হয় । এ বিশ্বাসের সারকথা হলো, আদম ও হাওয়া আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে পাপ করেছিলেন। আর মানুষ যেহেতু তাদেরই বংশধর, তাই তাঁরা পাপী হওয়ার কারণে তাঁদের সন্তানগণ ও পাপী এবং কিয়ামত পর্যন্ত যতো মানুষ দুনিয়াতে আসবে, সবাই পাপী , এখন দুইটি বিষয় দেখা দিল।

১/ আল্লাহ ন্যায় বিচারক অপরাধী কে পাপের শাস্তি না দিলে?

প্রকৃত খ্রিস্টান কারা?

প্রশ্ন:

যখনই আমি কোন খ্রিস্টানকে ইসলামের দাওয়াত দিতে যাই তখনই একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়,,, তারা উলটো আমাকে খ্রিস্টান হওয়ার জন্য বলে!!! যীশু বা ইসা আঃ কে যে অনুসরন করে তাকে যদি খ্রিস্টান বলা হয় তাহলে আমি মনে করি আমি খ্রিস্টানদের থেকেও বড় খ্রিস্টান। কারন :-

  • যীশু শোকরের গোশত খেত না [দ্বিতীয় বিবরন ১৪:৮]( আমিও খাইনা)

ইঞ্জিলের সরাসরি উদ্ধৃতি দিয়ে সবচেয়ে ভালো উত্তর হয়:

ঈসা তাঁদের বললেন, “তোমরা কি এতই অবুঝ?

ঈসা কি প্রত্যেকে ক্ষমা করেছেন?

প্রশ্ন:

খ্রিস্টানদের প্রতি কিছু প্রশ্ন:
১. যীশু (তার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) যদি সবার পাপ নিয়ে মারা যাই তাহলে

  • জাহান্নাম কেন সৃষ্টি করা হয়েছে
  • আর যিশু যখন পৃথিবীতে আসবে তখন কিসের বিচার করবেন?

আর যারা পাপি তারা যদি শাস্তি পায় তাহলে যীশু কাদের পাপ নিয়ে মারা গিয়েছেন?

হযরত পৌল এবং ইয়াকুব বিপরীত নয়?

ইয়াকুব—“নাজাতের ব্যাপারে হযরত পৌল এবং ইয়াকুব বিপরীত নয়?”

নাজাত আসে কাজের মাধ্যমে না ঈমানের মাধ্যমে? কিছু সমালোচক হযরত পৌল এবং ইয়াকুবের বিশেষ কিছু আয়াত নিয়ে দাবী করেন যে প্রথম ঈসায়ী নেতাদের মধ্যে এই ব্যাপারে অনেক অমিল ছিল। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফ ভালভাবে জানলে এই যুক্তি ভেঙ্গে যায়। হযরত পৌল এবং ইয়াকুবের সুসংবাদ বাণী এক ছিল, যদিও এরা শ্রোতাদের প্রয়োজন অনুসারে সুসংবাদের আলাদা অংশের উপর জোর দিতেন। তারা উভয় এই মূল বাণী বিশ্বাস করতেন:

শরিয়ত ভাল, কিন্তু তার মাধ্যমে কখনও নাজাত অর্জন করা সম্ভব না, যেহেতু মানুষ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তা পালন করতে পারে না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তার নাজাত এবং প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা প্রকাশ করেছেন—ঈসা মসীহ্‌। এই বিনামূল্য দান আল্লাহ্‌র কাছে গ্রহণ করতে হবে ঈমান দিয়ে, তওবা দিয়ে এবং তার উম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ভাল কাজ (শরিয়ত পালন) হচ্ছে প্রকৃত ঈমানের চিহ্ন বা ফলাফল। একজনের “ঈমান”-এর ফলে যদি ভাল কাজ না আসে তাহলে বোঝা যায় এটি সত্যিকারের ঈমান ছিল না (এবং সেই ব্যক্তির নাজাত হবে না)। তাই ঈমান এবং কাজ দু’টোই প্রয়োজন, কিন্তু ঈমান হচ্ছে ভিত্তি।

পৌল এবং ইয়াকুব দু’জনেরই লেখাগুলি উপরোক্ত বাণীর সঙ্গে মিলে যায়। হযরত পৌল কি সত্যি শরিয়তকে “ঘৃণা” করেছিলেন যেমন করে সমালোচকরা দাবী করেন?…

ঈসা মসীহ্‌ কি শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন?

দুটি আয়াত দিয়ে ঈসা-বিরোধী সমালোচকেরা বলেন যে হযরত ঈসা শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য। অবশ্য, হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ক্ষেত্রে এই কথা হয়ত বলা যায়, কারন কোরআন শরীফে লেখা আছে:

“এমনি ভাবে আমি আপনার প্রতি [মুহাম্মদ] আরবী ভাষায় কোরআন নাযিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশ-পাশের লোকদের সতর্ক করেন” (সুরা আশ-শুরা ৪২:৭)

কিন্তু ইঞ্জিল শরীফের পুরো সাক্ষ্য দেখলে বোঝা যায় যে ঈসা মসীহ্ প্রথমত ইহুদীদের কাছে গেলেন কিন্তু তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য। কিন্তু প্রথমে আমরা সেই দুই ভুলব্যাখ্যাকৃত আয়াত দেখব:

মথি ১০:৫—“এই আয়াত অনুযায়ী ঈসা মসীহ্‌ শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন”

মথি ১০ অধ্যায়ে ঈসা মসীহ্ তার সাহাবীদের পাঠিয়েছিলেন একটি বিশেষ সময়ের জন্য, এবার শুধু ইহুদীদের কাছে। এই যাত্রার নিয়ম নির্দিষ্ট একটি সময়ের জন্য দেওয়া হল, কারণ ইঞ্জিলে এই যাত্রার সমাপ্তির বর্ণনা আছে (লূক ৯), এবং পরে ঈসা মসীহ্ এই যাত্রার কিছু নিয়ম পরিবর্তন করেছিলেন (লূক ২২:৩৫-৩৬)।

মথি ১৫:২১-২৮—“এই আয়াত অনুযায়ী ঈসা মসীহ্‌ শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য এসেছিলেন

মথি ১৫:২১-২৮ (এবং মার্ক ৭:২৩-৩০) অনুচ্ছেদে ঈসা মসীহ্ একজন কেনানীয় মহিলাকে বোঝাছিলেন যে তার তবলিগ কাজ প্রথমত বনি-ইসরাইলদের কাছে।

এই দুই আয়াতের দশগুণ বেশী আয়াত ইঞ্জিলে পাওয়া যায় যেখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে মসীহ্র বাণী সমস্ত জাতির জন্য, এমনকি তৌরাত, জবুর ও নবীদের কিতাবেও এমন কথা আছে। অবশ্য তার দুনিয়াবি প্রচার-কাজ প্রথমত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে ছিল, কারণ হযরত ইবরাহিমের সময় থেকেই এই ইসরাইল জাতি ছিল আল্লাহ্‌র বাণীর হাতিয়ার। এইজন্য ঈসা মসীহ্ বনি-ইসরাইলীয়দের মধ্যে প্রচার করেছিলেন।

কিন্তু ঈসা মসীহ্র ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থিত হওয়ার পরপরেই নতুন একটি যুগ শুরু হল, আল্লাহ্ ও মানবজাতির মধ্যে নতুন একটি চুক্তি বা ব্যবস্থা ঈসা বহাল করেছিলেন। আগে জাতিরা ইসরাইলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সম্বন্ধে জানতে পারত, কিন্তু তখন থেকে সরাসরি ঈসা মসীহ্র মাধ্যমে সমস্ত জাতি আল্লাহ্‌র কাছে আসতে পারে। ঈসার ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগেও ঈসা বলেছিলেন:

“আমিই দুনিয়ার নূর।” (ইউহোন্না ৮:১২)

“আমিই পথ, সত্য আর জীবন। আমার মধ্য দিয়ে না গেলে কেউই পিতার কাছে যেতে পারে না।” (ইউহোন্না ১৪:৬)

ঈসা বলেছিলেন যে তার আত্ম-উৎসর্গ হবে:

“মানুষ যেন জীবন পায় সেইজন্য আমি আমার এই শরীর দেব।” (ইউহোন্না ৬:৫১)

এবং মসীহ্র বিষয় একটি ভবিষ্যদ্বানী মথি উল্লেখ করেছিলেন যে:

“তাঁরই উপর অ-ইহুদীরা আশা রাখবে।” (মথি ১২:২১)

যখন ইমাম শামাউন ঈসাকে বাইতুল মোকাদ্দসে ঈসাকে দেখতে পেলেন তিনি বললেন:

“আমার চোখ তোমার নাজাতের ব্যবস্থা দেখেছে…অন্য জাতির কাছে এটা পথ দেখাবার নূর” (লূক ২:৩১-৩২)

তার ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থানের পরে, ঈসা মসীহ্ সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে তার বাণী সমস্ত জাতির জন্য:

এইজন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর। পিতা, পুত্র ও পাক-রূহের নামে তাদের তরিকাবন্দী দাও। আমি তোমাদের যে সব হুকুম দিয়েছি তা পালন করতে তাদের শিক্ষা দাও। দেখ, যুগের শেষ পর্যন্ত সব সময় আমি তোমাদের সংগে সংগে আছি।” (মথি ১৮:১৯-২০)

লূকে সাহাবীদের কাছে ঈসা একই রকম হুকুম দিয়েছিলেন:

“জেরুজালেম থেকে শুরু করে সমস্ত জাতির কাছে মসীহের নামে এই খবর তবলিগ করা হবে যে, তওবা করলে গুনাহের মাফ পাওয়া যায়। তোমরাই এই সমস্ত বিষয়ের সাক্ষী।” (লূক ২৪:৪৬-৪৮)

এবং প্রেরিত কিতাবে তিনি সাহাবীদের হুকুম দিলেন:

তিনি তাদের বললেন, “জেরুজালেম, সারা এহুদিয়া ও সামেরিয়া প্রদেশে এবং দুনিয়ার শেষ সীমা পর্যন্ত তোমরা আমার সাক্ষী হবে।” (প্রেরিত ১:৮)

একজন ব্যক্তির শেষ বাণীর উপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়—এটাই ছিল ঈসা মসীহ্র শেষ হুকুম।

এর পরেও আগেকার কিতাবের বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বানীতে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে মসীহ্ সমস্ত জাতির জন্য ছিল। নবী ইশাইয়া লিখেছিলেন যে:

“সেই দিন ইয়াসিরের মূল সব জাতির জন্য নিশানের মত হয়ে দাঁড়াবেন; সব জাতি তাঁর কাছে জমায়েত হবে” (ইশাইয়া ১১:১০)

এবং

“দূরের লোকেরা তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে।” (ইশাইয়া ৪২:৪)

তেমনই ভাবে দানিয়েল নবী তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন যে:

সেই ইবনে আদমকে কর্তৃত্ব, সম্মান ও রাজত্ব করবার ক্ষমতা দেওয়া হল যেন সমস্ত জাতির, দেশের ও ভাষার লোকেরা তাঁর সেবা করে। তাঁর রাজত্ব চিরস্থায়ী; তা শেষ হবে না আর তাঁর রাজ্য কখনও ধ্বংস হবে না। (দানিয়েল ৭:১৪)

ঈসা মসীহ্র বারজন সাহাবী মৃত্যু পর্যন্ত সমস্ত জাতির কাছে মসীহ্র বাণী প্রচার করতে লাগলেন। তারা তো ঈসার শিক্ষা খুব ভালভাবে জানতেন। যদি ঈসা ‘কেবল ইহুদীদের জন্য’ হতেন, তাহলে তারা কেন জাতির কাছে তার বাণী প্রচার করতে করতে তাদের সারা জীবন নষ্ট করতেন কেন?…

ঈসার শিক্ষা অনুযায়ী কি শরিয়ত দ্বারা নাজাত পাওয়া যায়?

ঈসা মসীহের অন্যান্য ভূমিকা এড়ানোর জন্য দুএকটি আয়াতের ভিত্তিতে (মথি ৫:১৭, মথি ১৯:১৬-৩০) বলা হয় যে তিনি শুধু শরিয়ত সমর্থন করতে আসলেন। এটাই তাদের অভ্যাস— দুএকটি আয়াত ভুল-ব্যাখ্যা করা এবং বাকি ৯৯ আয়াত অবহেলা করা। তাই আসুন, আমরা তৌরাত থেকে শুরু করে ভালভাবে দেখব কিতাবুল মোকাদ্দসে নাজাত এবং শরিয়তের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করি:

তৌরাত শরীফে নাজাত

হযরত ঈসা যখন বার বার বললেন যে নাজাত শরিয়তের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না বরং রহমতের মাধ্যমে আসে, এটা কোন নতুন শিক্ষা ছিল না বরং তৌরাত এবং নবীদের কিতাবের শিক্ষার সঙ্গে মিলে যায়। তৌরাত শরীফ থেকে বলা হয়েছে যে নাজাত আসবে একজন ‘মসীহ্’ এর মাধ্যমে। পয়দায়েশে বলা হয়েছে যে ইবরাহিম “মাবুদের কথার উপর ঈমান আনলেন আর মাবুদ সেইজন্য তাঁকে ধার্মিক বলে গ্রহণ করলেন।” (পয়দায়েশ ১৫:৬)—তার ঈমানের জন্য, প্রচেষ্টার জন্য নয়।

হযরত মূসার শরিয়তে, এমন কথা কোথাও বলা হয় নি যে ‘এই শরিয়ত পালন করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে’:

“বনি-ইসরাইলরা, তোমরা আমার কথা শোন এবং সতর্ক হয়ে এই সব মেনে চল, যাতে দুধ আর মধুতে ভরা সেই দেশে যাবার পরে তোমাদের পূর্বপুরুষদের মাবুদ আল্লাহ্‌র ওয়াদা অনুসারে তোমাদের উন্নতি হয় আর তোমরা সংখ্যায় অনেক বেড়ে উঠতে পার।”(দ্বিতীয়বিবরণ ৬:৩)

বনি-ইসরাইলীয়দের জন্য মূসার শরয়িত পালনের পুরস্কার বেহেশত নয়, বরং প্যালেষ্টাইনে শান্তি ও সফলতা। আবার এই শরিয়তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাপ সম্বন্ধে চেতনা, যেন আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ্‌র ইচ্ছা কী কী এবং যে আমরা তা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পালন করচ্ছি না।

জবুর শরীফে নাজাত

প্রথমত, দাউদ নবীর জবুর শরীফে বলা হয় যে আল্লাহ্‌র সামনে সকল মানুষ গুনাহ্‌গার এবং নাজাত পাওয়ার অযোগ্য:

“আমার অন্যায়ের মধ্যে আমি ডুবে গেছি;
তা এমন বোঝার মত হয়েছে যা আমি বইতে পারি না।” (জবুর ৩৮:৪)

“তোমার এই সেবাকারীর বিচার কোরো না,
কারণ তোমার চোখে কোন প্রাণীই নির্দোষ নয়।”   (জবুর ১৪৩:২)

“তুমি আমার গুনাহের দিকে চেয়ে দেখো না;
আমার সমস্ত অন্যায় তুমি মাফ কর।” (জবুর ৫১:৯)

“আমার অন্তর নীরবে কেবল আল্লাহ্‌র অপেক্ষা করছে,
কারণ তিনিই আমার উদ্ধারকর্তা।
কেবল তিনিই আমার উঁচু পাহাড় আর আমার উদ্ধার;
তিনিই আমার কেল্লা আমি সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হব না।” (জবুর ৬২:১,২)

“হে মাবুদ, তুমি যদি অন্যায়ের হিসাব রাখ,
তবে হে মালিক, কে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে?

“হযরত পৌল ঈসা মসীহ্‌র বাণী তার নিজ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছে”

“হযরত পৌল ঈসা মসীহ্‌র বাণী তার নিজ উদ্দেশ্যে পরিবর্তন করেছে”

হযরত পৌল এবং অন্যান্য সাহাবীদের মধ্যে যে কোন বড় ধরণের বিবাদ বা দ্বন্দ্ব ছিল তার জন্য ইঞ্জিলে কোন প্রমাণও নেই, ইঞ্জিলের বাইরে কোন স্বীকৃত ঐতিহাসিক দলিলেও কোন প্রমাণ নেই। সমালোচকেরা প্রেরিত ১৫:৩৯ আয়াতে হযরত পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে তর্কটা অনেক বাড়িয়ে দেয়। এই আয়াত আমরা একটু দৃষ্টিপাত করি:

কিছু দিন পরে পৌল বার্নাবাসকে বললেন, “যে সব জায়গায় আমরা মাবুদের কালাম তবলিগ করেছি, চল, এখনই সেই সব জায়গায় ফিরে গিয়ে ঈমানদার ভাইদের সংগে দেখা করি এবং তারা কেমন ভাবে চলছে তা দেখি।” তখন বার্নাবাস ইউহোন্নাকে সংগে নিতে চাইলেন। এই ইউহোন্নাকে মার্ক বলেও ডাকা হত। পৌল কিন্তু তাঁকে সংগে নেওয়া ভাল মনে করলেন না, কারণ মার্ক পাম্ফুলিয়াতে তাঁদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের সংগে আর কাজ করেন নি। তখন পৌল ও বার্নাবাসের মধ্যে এমন মতের অমিল হল যে, তাঁরা একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলেন। বার্নাবাস মার্ককে নিয়ে জাহাজে করে সাইপ্রাস দ্বীপে গেলেন, আর পৌল সীলকে বেছে নিলেন। তখন এণ্টিয়কের ভাইয়েরা পৌল ও সীলকে মাবুদের রহমতের হাতে তুলে দিলে পর তাঁরা রওনা হলেন। পৌল সিরিয়া ও কিলিকিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়ে সমস্ত জামাতগুলোর ঈমান বাড়িয়ে তাদের আরও শক্তিশালী করে তুললেন। (প্রেরিত ১৫:৩৬-৪১)

এই ঘটনার আগে হযরত পৌল এবং বার্নাবাস দুই ভাই হিসেবে দীর্ঘদিনের একটি তবলিগ করেছিল একসাথে। উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে বোঝা যায় যে বিবাদের বিষয় মার্ককে সফরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নিয়ে। এটা কোন রকম ধর্মবিশ্বাসের বিবাদ ছিল না।

তার পরিবর্তে মজবুত প্রমাণ আছে যে এরা বিশ্বাসের ব্যাপারে একমত ছিল। যখন ৪৯ খ্রীষ্টাব্দে হযরত পৌল জেরুজালেমের ঈসায়ী নেতাদে্র সামনে তার বিশ্বাস এবং কাজের কথা বলেছিলেন, তখন এই সাহাবীরা খুশি হয়ে তাকে সম্পুর্ণভাবে গ্রহণ করলেন। হযরত পৌলের চিঠিগুলোর মধ্যে যে বিশ্বাস এবং সুসংবাদের কথা আছে, সেটা সাহাবী পিতর, সাহাবী ইয়াকুব এবং সাহাবী ইউহোন্নার চিঠিগুলোর মধ্যেও আছে। তারা ঈসায়ী মূল ‘সুসংবাদ’ বিশ্বাস নিয়ে একমত, যেটা এইভাবে সংক্ষিপ্ত করা যায়:

শুধু শরিয়ত পালন করার মাধ্যমে মানুষ নাজাত অর্জন করতে পারে না, কারণ তারা শরিয়ত পুঙ্খানপুঙ্খভাবে পালন করতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ্‌র রহমতে তিনি একটি নাজাত, কাফফারা এবং পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করলেন হযরত ঈসা মসীহ্‌র মাধ্যমে, যিনি একমাত্র নিষ্পাপ ব্যক্তি, “মনোনীত নাজাতদাতা”। তিনি ক্রুশে আমাদের পাপের শাস্তি বহন করলেন এবং পুনরুত্থিত হলেন। এই নাজাতের দান কোন সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায় না বরং তওবা করে ঈসা মসীহ্‌র উম্মত হওয়ার মাধ্যমে পাওয়া যায়।

উপরোক্ত ‘সুসংবাদ’ শিক্ষাটি ইঞ্জিল শরীফের প্রত্যেকটি ২৭ খণ্ডে বার বার পাওয়া যায়। পুরো এই একই সুসংবাদের বাণী হযরত ঈসা মসীহ্ নিজেই বার বার বলেছেন— মথি ২৬:২৮; ইউহোন্না ৩:১৫, মথি ২০:২৮; মার্ক ১০:৪৫; ইউহোন্না ১০:৯; ইউহোন্না ১৪:৬; ইউহোন্না ৬:৪৪,৪৭,৪৮,৫১; ইউহোন্না ১০:১১; ইউহোন্না ১০:২৮; ইউহোন্না ১১:২৫; ইউহোন্না ১৭:১-২; ইউহোন্না ১৭:৩; লূক ২৪:২৬-২৭; লূক ৪:৪৩; ইউহোন্না ৬:২৯; ইউহোন্না ৬:৩৩,৩৫; ইউহোন্না ৪:১৪; ইউহোন্না ৫:২১; মথি ১৮:২১-৩৫। এই একই সুসংবাদ প্রচার করেছেন হযরত ঈসার উম্মত পিতর (প্রেরিত ২:৩৮; প্রেরিত ৪:১২; ১ পিতর ১:১৮-১৯; ২ পিতর ১:১৬), উম্মত ইয়াকুব (ইয়াকুব ২:১০), এবং উম্মত ইউহোন্না (১ ইউহোন্না ২:১,২)।

হযরত পৌলের জীবনী পড়লে বোঝা যায় যে তার বাণী থেকে তিনি কোন রকম দুনিয়াবী লাভ পাননি, অর্থাৎ মসীহ্‌ প্রকৃত শিক্ষা বিকৃত করার জন্য তার কোন কারণ ছিল না। হযরত পৌল যেভাবে প্রচার করতেন সেটা তার স্বার্থের বিপরীত ছিল। মসীহ্‌র উপর ঈমান আনার আগে তার ভবিষ্যত উজ্জ্বল ছিল, তিনি বিখ্যাত আলেম গমলীয়েলের শিষ্য ছিলেন এবং রোমীয় নাগরিক ছিলনে (ইহুদীদের মধ্যে খুব কম লোকের এই সুবিধা ছিল)। মসীহ্‌র বাণী গ্রহণ না করলে তার নিশ্চয় মান-সম্মান, ধন এবং খ্যাতি অনেক থাকত। তিনি যদি ইহুদীদের কথামত বলতেন যে মসীহ্‌ কোন নাজাতদাতা নয় বরং শুধু একজন শরিয়ত-সমর্থক তাহলে সবাই তাকে পছন্দ করতেন এবং তার মান-সম্মান বেড়ে যেত। হযরত পৌল নিজেই লিখেছিলেন, “আমি যদি এখনও মানুষকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করি তবে তো আমি মসীহের গোলাম নই।” (গালাতীয় ১:১০)।

মসীহ্‌র উপর ঈমান আনার আগে, হযরত পৌল ঈসায়ী জামাতের কঠিন শত্রু ছিলেন, তিনি ঈসায়ীদের ধরে তাদেরকে জেলখানায় ফেলে দিতেন (প্রেরিত ৯)। এইভাবে দামেষ্ক যাওয়ার পথে তিনি হঠাৎ মসীহ্‌র দর্শন পেয়েছিলেন। দুনিয়াবী স্বার্থের দৃষ্টি থেকে, তখন থেকেই তার জীবন পতন হল। ঈমান আনার পর থেকে তার জীবন কষ্টে ভরা ছিল। তাকে অত্যাচার ও মারধর করা হত, চাবুক দিয়ে আঘাত করত, পাথর ছুড়ে মারত, এবং তার জীবনে বিপদ, হুমকি, খিদে ও পিপাসার অভাব ছিল না (২ করিন্থীয় ১১:২৩-২৯)। তিনি অনেক বছর জেল কেটেছেন এবং সফরে জাহাজের দুর্ঘটনা ও ডাকাতের বিপদ সহ্য করেছিলেন। এই সময়ে তিনি কষ্ট করে চামড়ার কাজ করে আয় করতেন যেন কারো কাছে টাকা চাইতে না হয়। শেষে রোম শহরে তিনি শহীদ হলেন। এমন জীবনের এমন ব্যক্তি যে নিজ স্বার্থে মসীহ্‌র বাণী বিকৃত করেছেন, তা বলা বোকামি এবং সম্পূর্ণ অবিশ্বাসযোগ্য।

কেউ অপরের বোঝা বহন করিবে না

“ঈসা মসীহ্‌ আমাদের পাপ বহন করতে পারেন না, কারণ কোরআনে বলা হয়েছে “কোন বহনকারী অপরের বোঝা বহন করিবে না” (সূরা ৫৩:৩৮)”

হযরত ঈসা মসীহ্‌ যে আমাদের পাপের শাস্তি বহন করেছেন, তা আসলে কোরআন শরীফের এই আয়াতে অস্বীকার করা হচ্ছে না। আয়াতটি এরকম—

তাহাকে কি অবগত করা হয় নাই যাহা আছে মূসার কিতাবে, এবং ইব্‌রাহীমের কিতাবে, যে পালন করিয়াছিল তাহার দায়িত্ব?

নাজাত: নেক কাজ দ্বারা নাকি কেবল আল্লাহ্‌র রহমত দ্বারা?

অনেক মুসলমান ভুল করে মনে করেন যে নাজাত মূলতঃ ভাল কাজ দিয়ে অর্জন করা যায়। কিন্তু কোরআন এবং সহীহ্‌ হাদীস কী বলে? দেখুন:

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। যে কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে, তখন তো শয়তান নির্লজ্জতা ও মন্দ কাজেরই আদেশ করবে। যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া তোমাদের প্রতি না থাকত, তবে তোমাদের কেউ কখনও পবিত্র হতে পারতে না কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করেন। আল্লাহ সবকিছু শোনেন, জানেন।”  (সূরা আন-নূর ২৪:২১)

  সহীহ্‌ হাদিস আরও পরিস্কার:

আবু হুরাইরা (রা) বলেন, আমি রসূলুল্লাহ (স)-কে বলতে শুনেছিঃ কোন ব্যক্তির নেক আমল কখনও তাকে জান্নাতে নিতে পারবে না। লোকেরা বললো, হে আল্লাহ্‌র রসূল!