কোরআন অনুযায়ী কি খ্রীষ্টানদের কিতাব পরিবর্তন হয়েছিল?

“কোরআন বলে যে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের কিতাব পরিবর্তন করা হয়েছে”

value=”http://www.youtube.com/v/Geu_Qq-N2iQ&hl=id_ID&fs=1?version=3&autohide=1&rel=0″ > type=”application/x-shockwave-flash”wmode=”transparent”allowscriptaccess=”always”width=”100%”>

বেশ কয়েক জায়গায় কোরআন শরীফে ইহুদীদের (খ্রীষ্টানদেরকে নয়) সমালোচনা করা হয়েছে যে তারা কিতাব থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার সময় শব্দ বিকৃত করে (حُيَرِّفُونَهُ -২:৭৫), গোপন করে (৬:৬১, ২:১৪০), পড়ার সময় তাদের জিহ্বা দ্বারা বিকৃত করে (يَلْؤنَ السِنَتَهُم -৩:৭৮) এবং এমনকি তেলাওয়াত করার সময়ে এরা শব্দগুলি সঠিক স্থান থেকে পরিবর্তন করে বলে (حُيَرِّفُونَ الكَلِمَ عَنْ مَوَاضِعِهِ – ৫:১২-১৪)। উদাহরণস্বরূপ:

আর নিশ্চয় তাহাদের মধ্যে একদল লোক আছেই যাহারা কিতাবকে জিহ্বা দ্বারা বিকৃত করে যাহাতে তোমরা উহাকে আল্লাহ্‌র কিতাবের অংশ মনে কর, কিন্তু উহা কিতাবের অংশ নহে, এবং তাহারা বলে,‘উহা আল্লাহ্‌র পক্ষ হইতে’ ; কিন্তু উহা আল্লাহ্‌র পক্ষ হইতে নহে। (আলে-‘ইমরান ৩:৭৮)

কোরআন কিন্তু একবারের জন্যও বলে না যে, কিতাবের লিখিত কোন অংশ পরিবর্তন করা হয়েছে, বা আসল কিতাবগুলি আজকের কিতাবগুলি থেকে ভিন্ন। এর বদলে, ইহুদী ও খ্রীষ্টান কিতাবগুলি সম্বন্ধে কোরআনে অনেক ভাল কথা বলা হয়েছে:

“ইঞ্জিল অনুসারীগণ যেন আল্লাহ্‌ উহাতে যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে বিধান দেয়। আল্লাহ্‌ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে যাহারা বিধান দেয় না , তাহারাই ফাসিক।” (সূরা মায়িদা ৫:৪৭)

“বল, হে কিতাবধারীগণ! তৌরাত, ইঞ্জিল, ও যাহা তোমাদের প্রিতিপালকের নিকট হইতে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হইয়াছে তোমরা তাহা প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত তোমাদের কোন ভিত্তিই নাই।” (সূরা মায়িদা ৫:৬৮)

“আমি তোমার প্রতি যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি উহাতে যদি তুমি সন্দেহে থাক তবে তোমার পূর্বের কিতাব যাহারা পাঠ করে তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর।” (সূরা ইউনুস ১০:৯৪)

“তাঁহার কালাম (বাক্য) পরিবর্তন করার কেহ নাই।” (সূরা আল-আন’আম ৬:১১৫)।

কোরআনের এই দুটি ভিন্ন মতের মধ্যে সমন্বয় সাধনের একমাত্র বৈধ উপায় আসলে কোরআনেই রয়েছে— সেখানে বারবার বলা হয়েছে যে, আহলে কিতাব অর্থাৎ কিতাবধারীদের মধ্যে দুটি দল (فَرِيق ফারিক) বা ভাগ (طَاءِفَه তাইফা) আছে, ভাল ও মন্দ। ধার্মিক বা ভাল দলের লোকেরা তাদের পবিত্র কিতাব রক্ষা করে এবং বিশ্বাস-সহকারে পালন করে, আর মন্দ দলের লোকেরা অকিতাবীয় শিক্ষা দেয় এবং তাদের নিজ স্বার্থে কিতাবের অর্থ বিকৃত করে:

“তাহারা সকলে একরকম নহে। কিতাবীদের মধ্যে অবিচলিত একদল আছে।” (আলে-‘ইমরান ৩:১১৩)

“কিতাবীদের মধ্যে এমন লোক আছে যাহারা আল্লাহ্‌র প্রতি বিনয়াবনত হইয়া তাঁহার প্রতি এবং তিনি যাহা তোমাদের ও তাহাদের প্রতি অবতীর্ণ করিয়াছেন তাহাতে অবশ্যই ঈমান আনে এবং আল্লাহর আয়াত তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করে না। ইহারাই তাহারা যাহারা যাহাদের জন্য আল্লাহর নিকট পুরস্কার রহিয়াছে।” (আলে-‘ইমরান ৩:১৯৯)।

“… উহাদের মধ্যে যাহারা ঈমান আনিয়াছিল, উহাদিগকে আমি দিয়াছিলাম পুরস্কার এবং উহাদের অধিকাংশই সত্যত্যাগী।” (সূরা হাদীদ ৫৭:২৭)

কোরআনের এই কাঠমো ব্যবহার করে, আমরা এই দুটি দলের চারিত্রিক বেশিষ্ট্য ভাগ করতে পারি:

 

ধার্মিক ভাল দল

ভ্রান্ত খারাপ দল

নৈতিকতা:

– অহংকারমুক্ত (৫:৮৩)

– আমানত করা সম্পদে বিশ্বস্ত (৩:৭৪)

– কল্যাণকর বিষয়ের নির্দেশ দেয়;

অকল্যাণ থেকে বারণ করে (৩:১১৩)

– সৎকাজের জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করতে থাকে (৩:১১৩)

– সৎকর্মশীল (৩:১১৩)

– নম্র ও করুণাময় (৫৭:২৭)

নৈতিকতা: -অবিশ্বস্ত, কৃপণ (৩:৭৪)

– বিশ্বাস ভঙ্গ করে (৩:৭৫)

– দুষ্কর্মকারী (৩:১১১)

– বিদ্রোহী ও নিয়ম লঙ্ঘনকারী (৩:১১২)

– ক্রোধে পূর্ণ (৩:১২০)

ধর্মতত্ত্ব ও মতবাদ:

-আল্লাহ্‌ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে (৩:১১৩)

-আল্লাহর ইবাদত করে এবং মাঝে মাঝে

সারারাত ইবাদত করে (৩:১১৩)

-তারা ভাল উদ্দেশ্যে সন্ন্যাসবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল, কিন্তু তারা তা বিশ্বস্তভাবে পালন করে নি (৫৭:২৭)

-তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই (৫:৬৯)

-তারা বিচারদিনে পুরস্কৃত হবে (৩:১১৩)

ধর্মতত্ত্ব ও মতবাদ:

– বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর একজন স্ত্রী আছে এবং তাই তাঁর দৈহিক পুত্র আছে (সূরা ৬:১০১,৭২:৩); তারা বলে,“আল্লাহ পুত্র সাব্যস্ত করে নিয়েছেন” (১০:৬৮)

– তারা তিনজন পৃথক উপাস্যে বিশ্বাস করে: ঈসা, মরিয়ম ও আল্লাহ্‌ (৫:১১৬); তারা বলে,“আল্লাহ্‌ তিনজনের মধ্যে একজন উপাস্য (৫:৭৩)

– তারা মনে করে যে, তারা আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে (৫৭:২৯)

– তারা ইবরাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব, মুসা ও ইহুদীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করে।

কিতাবের প্রতি তাদের মনোভাব:

-তাদের ধর্মগ্রন্থ তেলাওয়াত করে (৩:১১৩)

-যথাযথভাবে পাঠ করে(২:১২১)

-বিশ্বাস করে(২:১২১)

– তাদের কিতাব অনুসারে বিধান দেয়(৫:৪৭)

কিতাবের প্রতি তাদের মনোভাব:

– আল্লাহর গ্রন্থকে পশ্চাতে নিক্ষেপ করল-যেন তারা জানেই না। (২:১০১)

– জানিয়া শুনিয়া আল্লাহ্‌ সম্পর্কে মিথ্যা বলে(৩:৭৫)

– জানিয়া শুনিয়া সত্য গোপন করিয়া থাকে(২:১৪৬)

– মিথ্যা আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আল্লাহর গ্রন্থের কিছুই জানে না, শুধু অমূলক ধারণা পোষণ করে (২:৭৮)

ঈসার শিক্ষা সম্পর্কে অভিমত:

-বলে মসিহ্‌ ছিলেন আল্লাহ্‌র দাস (৪:১৭২)

-বলে মসিহ্‌ ছিলেন কালাম (বাক্য)

ঈসার শিক্ষা সম্পর্কে অভিমত:

– তারা ঈসার মানবত্বকে অস্বীকার করে(৫:৭৫) এবং বলে যে, ঈসা বলে,“আল্লাহর পরিবর্তে আমার দাস হইয়া যাও”(৩:৭৯) এবং “ফেরেশতা ও নবীগণকে তোমাদের উপাস্যরূপে ইবাদত কর”।

মুসলিমদের প্রতি মনোভাব:

-“তুমি দেখবে… যাহারা বলে,“আমরা খ্রীষ্টান।”মানুষদের মধ্যে তাহাদিগকেই তুমি মুমিনদের নিকটতর বন্ধুত্বে দেখিবে। (৫:৮২)

মুসলিমদের প্রতি মনোভাব:

– তারা মুসলিমদের ভালবাসে না (৩:১১৯)

– মুসলিমদের ক্ষতিতে আনন্দ করে (৩:১২১)

– মুসলিমদের শত্রু (৫:৮২)

উপরের তালিকা থেকে বোঝা যায় যে “ধার্মিক” ঈসায়ী অংশটির ঈমান ও আমল ইঞ্জিল শরীফের শিক্ষার সঙ্গে মিলে যায়, কিন্তু এই কোরআন-বর্ণিত “মন্দ” অংশটি ইঞ্জিলের শিক্ষার বিপরীত। কোরআন শরীফ সম্ভবত একটি ছোট খারেজী খ্রীষ্টিয় দল বর্ণনা করেছে যারা বিশ্বাস করতেন যে মরিয়মের সঙ্গে ঈশ্বরের যৌন সম্পর্ক ছিল (নাউজুবিল্লাহ্‌!) এবং ঈসা হচ্ছেন সেই সম্পর্কের দৈব ফল। ঐতিহাসিক তথ্যাদি প্রমাণ করে যে, এই কোরআনে বর্ণিত “খারাপ খারেজীয় অংশটি” খ্রীষ্টধর্মমতের একটি খুবই ছোট অংশ, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ খ্রীষ্টানদের দ্বারাও প্রত্যাখ্যাত হতো।

কিতাব পরিবর্তন করা না অর্থ বিকৃত করা?

এবার আসুন কিতাব বিকৃতির অভিযোগুলো যাচাই করে দেখা যাক। তিনটি আলাদা অভিযোগ আছে: ১) সামান্য মূল্যে আয়াত বিক্রয় করা, ২) আয়াত অনুবাদের সময় বিকৃত, গোপন ও ইচ্ছামত রূপ দেওয়া, এবং ৩) আয়াতগুলি পরিবর্তন করা (التَّحْرِيف তাহ্‌রিফ)।

প্রথম অভিযোগটি, কম মূল্যে আয়াতসমূহ বিক্রয় করার অভিযোগটি, খ্রীষ্টানদের নয় বরং প্রধানত মূর্তিপূজাকারীদের প্রতি বলা হচ্ছে, যারা নিজের রচনা হিসেবে মোহাম্মদ(সাঃ)-এর সূরাগুলো বিক্রয় করতেন।

দ্বিতীয় অভিযোগটি, আয়াতসমূহ গোপন ও বিকৃত করার বিষয়টি উপরোক্ত মন্দ খ্রীষ্টিয় দলের প্রতি বলা হচ্ছে, যারা ইঞ্জিলের কথা গোপন রেখে ইঞ্জিল-বিপরীত শিক্ষা দিতেন। উদাহরণস্বরূপ, কোরআন অনুযায়ী তারা মানুষকে শিক্ষা দিতেন যে ঈসা বলেছিলেন,“আল্লাহ্‌র পরিবর্তে আমার ইবাদত কর” এবং “ফেরেশতাগণকে আল্লাহ হিসাবে সেবা কর”, কিন্তু তারা ইচ্ছাকৃতভাবে গোপন রাখলেন যে ইঞ্জিলে বিপরীত কথা লেখা আছে।

তৃতীয় অভিযোগ, কিতাব পরিবর্তনের বিষয়টি, কোরআনের চারটি আয়াতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটা মূলত ইহুদী তাদের নিজেদের কিতাবসমূহ নিয়ে নয়, বরং মোহাম্মদ(সাঃ)-এর কোরআন নিয়ে ইহুদীরা যা করে সেটা বর্ণনা করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। “শব্দগুলি পরিবর্তন করা” (التَّحْرِيف اللَفْظي আল-তাহ্‌রিফ আল-লাফ্‌জী ) কথাটি কখনও ইহুদী বা খ্রীষ্টানদের কিতাব সম্বন্ধে ব্যবহার করা হয় নি।

সুতরাং পরিশেষে, আমরা দেখি যে, কোরআন যদিও একটি ভ্রান্ত খ্রীষ্টান দলের সমালোচনা করে (যারা তিনজন আল্লাহ্‌র কথা বলতেন ও ইঞ্জিলের অর্থ বিকৃত করতেন), তবুও কোরআন তৎকালীন সত্যিকার খ্রীষ্টান দল, যারা ইঞ্জিল পালন করতেন ও সঠিকভাবে ইঞ্জিল আবৃত্তি বা তেলাওয়াত করতেন, এবং আল্লাহ্‌ ও শেষদিনের উপরে বিশ্বাস রাখতেন, তাদের সম্বন্ধেই ইতিবাচক কথা বলে কোরআন শরীফ, এবং তাদেরকে তাদের কিতাবসমূহ দ্বারা বিচার করার কথা বলা আছে।


অন্যান্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ:

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *