কোরবানী সম্পর্কে

সুন্নি শরীয়ত অনুযায়ী, কোরবানী দেওয়া ফরজ না বরং ওয়াজিব। কিন্তু ইরানে বলা হয় যে কোরবানী কেবন মক্কায় যারা হজ্জে যায় তাদের জন্য ওয়াজিব; তাই খুব কম লোক ইরানে কোরবানী দেয়। তাই ধর্মের ব্যাপারে অনেক মতবাদ আছে।

কোরবানী সম্পর্কে কোরআন শরীফে আমরা পড়ি:

“সুতরাং আমি তাকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখিযে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিতাঃ! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, তাই করুন। আল্লাহ চাহে তো আপনি আমাকে সবরকারী পাবেন।

যখন পিতা-পুত্র উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইব্রাহীম তাকে যবেহ করার জন্যে শায়িত করল। তখন আমি তাকে ডেকে বললামঃ হে ইব্রাহীম, ‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে! আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।

আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে।’ ”

(সূরা আস-সাফফাত ৩৭:১০১-১০৭)

এখন, সন্তানের কাছে যদি বাপ বলে, “আমি দর্শন পেয়েছি যে তোমাকে আমি যবাই করব”, তখন সন্তান কী বলবে? মায়ের কাছে দৌঁড় দিয়ে বলবে, “মা, বাবা পাগল হয়ে গেছে, তার মাথায় পানি ঢালো, আমাকে রক্ষা কর!” এখন শুনুন তৌরাতে এই ঘটনার বর্ণনা:

“হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ছেলেকে কোরবানী দেওয়া আল্লাহ্ বললেন, “তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলে ইসহাককে, যাকে তুমি এত ভালবাস তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া এলাকায় যাও। সেখানে যে পাহাড়টার কথা আমি তোমাকে বলব তার উপরে তুমি তাকে পোড়ানো-কোরবানী হিসাবে কোরবানী দাও।” সেইজন্য ইব্রাহিম খুব ভোরে উঠে একটা গাধার পিঠে গদি চাপালেন। তারপর তাঁর ছেলে ইসহাক ও দু’জন গোলামকে সংগে নিলেন, আর পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠ কেটে নিয়ে যে জায়গার কথা আল্লাহ্ তাঁকে বলেছিলেন সেই দিকে রওনা হলেন। তিন দিনের দিন ইব্রাহিম চোখ তুলে চাইতেই দূর থেকে সেই জায়গাটা দেখতে পেলেন। তখন তিনি তাঁর গোলামদের বললেন, “তোমরা গাধাটা নিয়ে এখানেই থাক; আমার ছেলে আর আমি ওখানে যাব। ওখানে আমাদের এবাদত শেষ করে আবার আমরা তোমাদের কাছে ফিরে আসব।” এই বলে ইব্রাহিম পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠের বোঝাটা তাঁর ছেলে ইসহাকের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নিজে আগুনের পাত্র ও ছোরা নিলেন। তারপর তাঁরা দু’জনে একসংগে হাঁটতে লাগলেন। তখন ইসহাক তাঁর পিতা ইব্রাহিমকে ডাকলেন, “আব্বা।”

ইব্রাহিম বললেন, “জ্বী বাবা, কি বলছ?”

ইসহাক বললেন, “পোড়ানো-কোরবানীর জন্য কাঠ আর আগুন রয়েছে দেখছি, কিন্তু ভেড়ার বাচ্চা কোথায়?” ইব্রাহিম বললেন, “ছেলে আমার, পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আল্লাহ্ নিজেই ভেড়ার বাচ্চা যুগিয়ে দেবেন।” এই সব কথা বলতে বলতে তাঁরা এগিয়ে গেলেন। যে জায়গার কথা আল্লাহ্ ইব্রাহিমকে বলে দিয়েছিলেন তাঁরা সেখানে গিয়ে পৌঁছালেন। সেখানে পৌঁছে ইব্রাহিম একটা কোরবানগাহ্ তৈরী করে তার উপর কাঠ সাজালেন। পরে ইসহাকের হাত-পা বেঁধে তাঁকে সেই কোরবানগাহের কাঠের উপর রাখলেন। তারপর ইব্রাহিম ছেলেটিকে মেরে ফেলবার জন্য ছোরা হাতে নিলেন। এমন সময় মাবুদের ফেরেশতা বেহেশত থেকে তাঁকে ডাকলেন, “ইব্রাহিম, ইব্রাহিম!”

ইব্রাহিম জবাব দিলেন, “এই যে আমি।” ফেরেশতা বললেন, “ছেলেটির উপর তোমার হাত তুলো না বা তার প্রতি আর কিছুই কোরো না। তুমি যে আল্লাহ্‌ভক্ত তা এখন বুঝা গেল, কারণ আমার কাছে তুমি তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলেকেও কোরবানী দিতে পিছ্পা হও নি।” ইব্রাহিম তখন চারদিকে তাকালেন এবং দেখলেন তাঁর পিছনে একটা ভেড়া রয়েছে আর তার শিং ঝোপে আট্কে আছে। তখন ইব্রাহিম গিয়ে ভেড়াটা নিলেন এবং ছেলের বদলে সেই ভেড়াটাই তিনি পোড়ানো-কোরবানীর জন্য ব্যবহার করলেন। তিনি সেই জায়গাটার নাম দিলেন ইয়াহ্ওয়েহ্ যিরি (যার মানে “মাবুদ যোগান”)। সেইজন্য আজও লোকে বলে, “মাবুদের পাহাড়ে মাবুদই যুগিয়ে দেন।”

(তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ২২:১-১৪)

এখানে ইবরাহীমের কোরবানীর ঘটনার আরো বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়।

তাহলে কোরবানী কী জিনিস? কোরবানী হল রক্ত বের করা। সর্বপ্রথম কোরবানী, রক্ত বের করা, কখন হয়েছিল? সেটা হয়েছিল হযরত আদম (আঃ)-এর পাপের ঠিক পরে, এবং আল্লাহ্‌ নিজেই এই কোরবানী করলেন:

আদম ও তাঁর স্ত্রীর জন্য মাবুদ আল্লাহ্ পশুর চামড়ার পোশাক তৈরী করে তাঁদের পরিয়ে দিলেন। (তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ৩:২১)

কোরবানীর উদ্দেশ্য হল গুনাহ্‌ ঢেকে দেওয়া, বা কাফফারা দিয়ে পাপীকে মুক্ত করা। সূরা সাফফাতে আমরা একই ধারণা দেখি-

وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ
আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে।’ ”
(সূরা আস-সাফফাত ৩৭:১০১-১০৭)

“মুক্তিপণ” (আরবীতেفدية ফাদিয়া) বোঝায় কোন কিছুর পরিবর্তে কাউকে মুক্ত করা। বলা হয়েছে যে ইবরাহিমের পুত্রের জীবন মুক্ত করা হয়েছে একটি ‘মহান’ (عَظِيمٍ ‘আজীম) কোরবানী দিয়ে। কোন কিছু মুক্ত করতে হলে মুক্তিপণের মূল্য বেশী হতে হয়। একটি ছাগল বা ডুম্বা কি আশরাফুল মাখলুকাতের চেয়ে বেশী মূল্যবান? অবশ্যই না। তাহলে বোঝা যায় যে ভবিষ্যতের অন্য একটি মহান কোরবানীর কথা বলা হচ্ছে। তেমনভাবে তৌরাত শরীফে হযরত ইবরাহিম বলেছিলেন যে, “পোড়ানো-কোরবানীর জন্য আল্লাহ্ নিজেই ভেড়ার বাচ্চা যুগিয়ে দেবেন।” কিন্তু এই ঘটনার সময়ে একটি পূর্ণ বয়সের ভেড়া দেওয়া হল, ভেড়ার বাচ্চা হয়, অর্থাৎ আসল “ভেড়ার বাচ্চা” (ভেড়ার বাচ্চা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে নিখুত বা বে-গুনাহ্‌) মুক্তিপণ পরে হবে।

তাই তখনকার কোরবানীগুলো শুধু একটা নমুনা বা নকশা ছিল, চুড়ান্ত আসল কোরবানী পরে দেওয়া হল। যে একটা কোরবানী পরে হবে, তার পূর্বাভাষ ছিল।

লক্ষ্য করুন যে হযরত ইবরাহীম একাই একটি পূর্ণ-বয়সের ভেড়া করবানী করে দিল। সাধারণত এমন পশু ধরে যবাই করতে চার-পাঁচজন লাগে। এই ভাবে বোঝায় যায় যে আসল কোরবানী সেচ্চায় জীবন দিতে হবে, আল্লাহ্‌ শুধু এমন কোরবানী গ্রহণ করেন।

এখন দেখি জবুর শরীফে কোরবানীর বিষয় কী বলা হয়েছে:

“তোমার পশু-কোরবানী নিয়ে আমি তোমাকে দোষী করছি না;

তোমার পোড়ানো-কোরবানী সব সময়ই তো আমার সামনে রয়েছে।

তোমার গোয়ালের কোন ষাঁড়ের আমার দরকার নেই,

তোমার খোঁয়াড়ের ছাগলও নয়; কারণ বনের সব প্রাণীই আমার,

অসংখ্য পাহাড়ের উপরে ঘুরে বেড়ানো পশুও আমার।

এমন কি, পাহাড়ের সব পাখীও আমার জানা আছে,

মাঠের সব প্রাণীও আমার।

আমার খিদে পেলেও আমি তোমাকে বলতাম না,

কারণ দুনিয়া আমার

আর তার মধ্যে যা কিছু আছে সবই আমার।

তুমি কি মনে কর ষাঁড়ের গোশ্‌ত আমার খাবার?

ছাগলের রক্ত কি আমি খাই?

আল্লাহ্‌র কাছে তোমার শুকরিয়াই তোমার কোরবানী হোক;

সেই মহানের কাছেই তোমার সব মানত পূরণ করতে থাক।

তোমার বিপদের দিনে তুমি আমাকে ডেকো;

আমি তোমাকে উদ্ধার করব

আর তুমি আমাকে সম্মান করবে।”

(জবুর শরীফ ৫০:৮-১৫)

আমার বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পথে যদি মনে পড়ে যে খালি হাতে আসছি, তখন যদি সেই বন্ধুর গেইটে ঢুকে তার পিয়ারা গাছ থেকে কয়েকটা পিয়ারা তুলে তার হাতে দিয়ে বলি, “এই, তোমার জন্য এগুলো”, তাহলে সেই বন্ধু কী চিন্তা করবে? “শালাটা আমার নিজের গাছের ফল আমাকে দিচ্ছে!” আমাদের চূড়ান্ত কোরবানী আল্লাহ্‌ জোগাড় করেছেন এবং আমাদের কোরবানী হচ্ছে আত্ম-উৎসর্গ।

“কিন্তু যে একটা গরু কোরবানী করছে সে যেন মানুষ খুন করছে,

যে একটা ভেড়ার বাচ্চা কোরবানী করছে সে যেন কুকুরের ঘাড় ভেংগে দিচ্ছে ”          (কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৬৬:৩)

আমাদের কোরবানী এখন গরু-ছাগলের গলা কেটে রক্ত বের করা নয়, বরং নিজেকে সমর্পণ করা। ঈদের দিনে বড় ইমামদের রক্তাক্ত আলখাল্লা এবং হাতে লম্বা ছোরা দেখে মনে হয়, তিনি হয়ত মানুষের সঙ্গে একই ব্যবহার করতে পারে।

“আমি বিশ্বস্ততা চাই, পশু-কোরবানী নয়;

পোড়ানো-কোরবানীর চেয়ে আমি চাই যেন মানুষ সত্যিকারভাবে আল্লাহ্‌কে চেনে।”

(কিতাবুল মোকাদ্দস, হোসিয়া ৬:৬)

আসল কোরবানীটা হল একটি সৎ, ন্যায়পূর্ণ জীবন, সেটা আরো কঠিন কোরবানী। আমি যদি একজনকে বলি, ‘আমাকে কিছু টাকা ধার কর, আমি আগামি কাল বিকালে তোমাকে টাকাটা ফিরত দিব’, এবং পরের দিন বিকালে আমি না আসি, এমন বিষয়ের কথা বলছি – আমাদের কথা রাখা, সততা, এটা হচ্ছে আসল কোরবানী। হাটে গিয়ে গরু কিনা সহজ, কিন্তু আসল কোরবানী কঠিন। আমাদের জন্য চুড়ান্ত কোরবানী হিসাবে মসীহ্‌ স্বেচ্চায় জীবন দিয়েছিলেন; এখন আমাদের উপযুক্ত কোরবানী হল নিজের জীবন উৎসর্গ করা:

“তাহলে ভাইয়েরা, আল্লাহ্‌র এই সব দয়ার জন্যই আমি তোমাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করছি, তোমরা তোমাদের শরীরকে জীবিত, পবিত্র ও আল্লাহ্‌র গ্রহণযোগ্য কোরবানী হিসাবে আল্লাহ্‌র হাতে তুলে দাও। সেটাই হবে তোমাদের উপযুক্ত এবাদত।”      (ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ১২:১)

এটা হল আসল কোরবানী, ফানাফুল্লাহ্‌ হওয়া; নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক জীবন আল্লাহ্‌র হাতে তুলে দেওয়া।

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *