সূরা বাকারা ২:৯৭ আয়াতে ‘কিতাব পরিবর্তন’

“সূরা বাকারা ২:৯৭ আয়াতে স্পষ্টভাবে আছে যে ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা তাদের কিতাব পরিবর্তন করেছেন”

কোরআনে একটিমাত্র আয়াত আছে (২:৭৯), যাতে মনে হয় কিতাবীয় বিকৃতির কথা বলা হচ্ছে এবং যেটা পুর্ববর্তী-কিতাব বিরোধী সমালোচকদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়:

“যখন তাহাদের [ইহুদীদের] একদল (فَرِيق ফারীক ) আল্লাহর বাণী [কোরআন] শ্রবণ করে অতঃপর তাহারা উহা বিকৃত করে, অথচ তাহারা জানে। … তাহাদের মধ্যে এমন কতক নিরক্ষর লোক আছে যাহাদের মিথ্যা আশা ব্যতীত কিতাব সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নাই, তাহারা শুধূ অমূলক ধারণা পোষণ করে। সুতরাং দুর্ভোগ তাহাদের জন্য যাহারা নিজ হাতে কিতাব রচনা করে এবং তুচ্ছ মূল্য প্রাপ্তির জন্য বলে ,‘ইহা আল্লাহ্‌র নিকট হইতে’। তাহাদের হাত যাহা রচনা করিয়াছে তাহার জন্য শাস্তি তাহাদের এবং যাহা তাহারা উপার্জন করিয়াছে তার জন্য শাস্তি তাহাদের। (সূরা বাকারা ২:৭৫,৭৮-৭৯)

৭৫ আয়াত থেকে আমরা বুঝি যে, আলোচ্য “কিতাব”টি হচ্ছে কোরআন (আগের আমলের কিতাবগুলি নয়) যা ইহুদীরা বিকৃত করেছে। এই অনুচ্ছেদে মদিনার ইহুদীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে যে এরা নিজের স্বার্থে হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)-এর কথা বিকৃত করতেন।

৭৮-৭৯ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, ইহুদীদের মধ্যে অবস্থিত কিছু “নিরক্ষর” লোক নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে সেটাকে আসমানী কিতাব হিসেবে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতেন। প্রথমেই একটি সরাসরি বিরোধ দেখা দিচ্ছে, যেহেতু নিরক্ষর অর্থই হচ্ছে লিখতে অসমর্থ! কিন্তু ‘নিরক্ষর’ শব্দটি মূল আরবী হচ্ছে উম্মিউন (أُمِّيُّونَ), যার অন্য অর্থ ইবনে আব্বাস অন্যান্যদের মতে “অইহুদী”, (Gentile বা পৌত্তলিক), অর্থাৎ আরববাসী ইহুদী বা খ্রীষ্টান কোনটিই নয়। যেহেতু এই মিথ্যা কিতাব লেখকগণ স্পষ্টতই লেখাপড়াজানা লোক ছিল, তাই আমাদের ধরে নিতে হবে যে, এই ‘উম্মিউন’ বলতে এরা অ-ইহুদী ছিল, ইহুদী বা খ্রীষ্টান নয়।

এ যুক্তি ইতিহাসের দলিলের সঙ্গে খাপ খায়, কারণ তখনকার বেশ কয়েকজন অইহুদী ও অবিশ্বাসী আরব কবি ছিল যারা তাদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য মিথ্যা ওহী রচনা করতো। মোহাম্মদ(সাঃ)-এর জীবদ্দশায় নাদির ইবনে হারিস (মৃঃ ৬২৪খ্রীঃ) নামের একজন আরবীয় কবি মোহাম্মদের সভা-সমিতিগুলিতে বাধা সৃষ্টি করতো এবং মোহাম্মদকে ছাড়িয়ে যাবার উদ্দেশ্যে অনারবদের কাছ থেকে শোনা গল্পগুলি কোরআনের মত একই ভঙ্গীতে আবৃত্তি করতো। মুসাইলিমা নামে মোহাম্মদের সময়কার আরেকজন অইহুদী অখ্রীষ্টান আরবীয় লোক নিজেকে নবী হিসেবে দাবী করে কোরআনের মত আয়াত রচনা করে ওহী হিসাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করতো। মুসলিমদের বিখ্যাত আল-ইয়ামামার যুদ্ধটি এই মুসাইলিমার অনুসারীর বিরুদ্ধে আনা হল। ইমাম রাজীর মতানুসারে, সূরা ৬:৯৩ হচ্ছে মুসাইলিমার বিষয়:

“তাহার চেয়ে বড় যালিম আর কে যে আল্লাহ্‌ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিংবা বলে ,‘আমার নিকট ওহী হয়’, যদিও তাহার প্রতি নাযিল হয় না?” (সূরা আল আন’আম ৬:৯৩)

সানা’আ এলাকায় আল-আনসি নামের আরেকজন অইহুদী এই একই ধরণের নবুয়াতের দাবী করেছিল এবং সে যে ওহী প্রাপ্ত হয়েছে সেটা লোকেরাও বিশ্বাস করেছিল। ইতিহাস থেকে আমরা আরও অসংখ্য অইহুদী ভণ্ড নবীদের সম্বন্ধে জানি, যেমন মানি (مانی),মাজদাক (مزدک), আল মুকান্না (المقنع), ও বাহাউল্লাহ্‌ (بهاء الله); এরা সবাই মধ্যপ্রাচ্যের অইহুদী যারা নিজেরা মিথ্যা ‘কিতাব’ রচনা করেছিল এবং বলেছিল যে সেগুলি একই আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই, ইহুদী ও খ্রীষ্টানগণ এই সমস্ত কিতাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, কারণ তাদের কাছে সত্যিকার কিতাব ছিল।

কোরআনে বর্ণিত “উম্মিউন” (অইহুদী) প্রতারণাকারী, যারা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের মধ্যে আসার পরে মিথ্যা কিতাব রচনা করে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বলেছিল যে, “এগুলি সব আল্লাহ্‌ থেকে এসেছে”, এই ধরনের লোকের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়—এদেরই বিরুদ্ধে কোরআনের এইসব অভিযোগ আনা হচ্ছে। এই আয়াতের সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাখ্যা এই হবে যে, এখানে বর্ণিত ভণ্ড নবীরা হচ্ছে অইহুদী অখ্রীষ্টান আরব ভণ্ড নবী। আর কোরআনের বাকি অংশটি, যা স্পষ্টতই তখনকার তৌরাত ও ইঞ্জিলকে পবিত্র কিতাব হিসাবে সম্মান করে তার সঙ্গে এটি সঙ্গতিপূর্ণ হবে।

আমরা এই আয়াতটি ইহুদীরা তাদের তৌরাত (খ্রীষ্টানদের ইঞ্জিল নয়) বিকৃত করেছে বলে ব্যাখ্যাও করি, তবুও আল-তাবারীর মত প্রাথমিক যুগের তাফসীরকারীগণ কিন্তু কোন লিখিত অংশের পরিবর্তন বোঝাতে এটা ব্যাখ্যা করেন না। বিশিষ্ট ইসলামী অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল্লাহ্‌ সূরা বাকারা ২:৭৯ আয়াতটি সম্বন্ধে তাবারীর ব্যাখ্যাটি এইভাবে বর্ণনা করেন:

The form of distortion that Tabari seems to refer to in this instance is that of writing down certain interpretations and attributing them to Allah, not changing a written text (word of God).
[এই ক্ষেত্রে তাবারী যে ধরণের বিকৃত কথা বলছে তা হচ্ছে, কোন লিখিত কিতাব পরিবর্তন করা নয় বরং কিছু ব্যাখ্যা লিখে সেগুলো আল্লাহ্‌র বাণী বলে ঘোষণা করা।]

কেবল ইবনে-খাজেম (মৃঃ ১০৬৪ খ্রীঃ)-এর যুগেই কিছু মুসলমান বলতে লাগলেন যে, ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা তাদের কিতাব পুরোপুরি বিকৃত করেছে, অর্থাৎ কিতাবের লেখাটা পরিবর্তন করেছে। এটা ছিল মোহাম্মদের সময়ের কয়েক শত বছর পরে, এবং তাদের এই ভুল ধারণা প্রথম যুগীয় ইবনে আব্বাসের কথার বিপরীত।

এটা বলা একেবারেই বোকামী যে, আল্লাহ্‌-ভীরু খ্রীষ্টান ও ইহুদীরা নিজেদেরকে বিভ্রান্তিতে রেখে তাদের পবিত্র কিতাব পরিবর্তন করতে দেবে। ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের প্রতি মোহাম্মদের এমন পরামর্শ ছিল না যে, তারা তাদের কিতাবসমূহ বাদ দিয়ে কোরআন অনুসরণ করবে, বরং তিনি একথা বলতেন যেন তারা তাদের কিতাবসমূহ অনুসারে বিধান দেয় (সূরা মায়িদা ৫:৪৭)। জাকির নায়েকের মত সমালোচকেরা এই আয়াতটির অপব্যবহার করে অভিযোগ করে যে, খ্রীষ্টানরা তাদের কিতাবসমূহ পরিবর্তন করেছে, কিন্তু এই আয়াতটি খ্রীষ্টানগণ বা ইঞ্জিল কোনটি সম্বন্ধেই নয়, বরং মোহাম্মদের বাক্যের সঙ্গে বিদ্বেষপরায়ণ ইহুদীদের বিদ্রুপ এবং অ-ইহুদী ভণ্ড নবীগণ কর্তৃক তাদের নিজেদের বিধান তৈরি সম্বন্ধে বলা হয়েছে।


অন্যান্য সম্পর্কিত প্রবন্ধ:

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *