মার্ক ১৬:১৪-১৮ – প্রকৃত ঈসায়ী হওয়ার পরীক্ষা?

মার্ক ১৬:১৪-১৮—“এই আয়াতের পরীক্ষা অনুযায়ী, একজন প্রকৃত ঈসায়ী হতে হলে সব ভাষায় কথা বলতে হবে এবং বিষ খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে।”

ইঞ্জিলের সমালোচকগণ হযরত ঈসা মসীহ্র এই কথা ভুলব্যাখ্যা করে সেটাকে একটি পরীক্ষা বানিয়েছে – প্রকৃত ঈসায়ী হতে হলে, এই চ্যালেঞ্জে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু একই যুক্তি অনুযায়ী, মুসলমানদের জন্য তেমন একটা ‘পরীক্ষা’ রয়েছে – হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, “যে চুপ থাকে সে নাজাত পায়।” – অর্থাৎ এই যুক্তিতে, যারা জীবনে একবারও মুখ খুলে, তারা জাহান্নামী। কিন্তু এই দুই ক্ষেত্রে আসল ব্যাখ্যা হচ্ছে যে প্রকৃত ঈমানদারের জীবনে এই ধরনের প্রবণতা বেশী দেখা যায় (চুপ থাকা, বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা এবং বিষ খেয়ে বেঁচে থাকা)।

এই আয়াতে বলা হয়নি যে প্রত্যেক ঈমানদারের মধ্যে এই অলৌকিক গুণ সবসময় দেখা যাবে, বরং বলা হচ্ছে যে ঈমানদারদের মধ্যে এই চিহ্ন দেখা যাবে। এটা নিশ্চয় কোনো ‘falsification test’ (δοκιμάζω) নয়। তার সাহাবীদের জন্য একটি প্রতিজ্ঞা হিসেবে ঈসা মসীহ্ এই কথা বলেছেন, যে শয়তান যাই করেন না কেন, তিনি ঈমানদারদের উপর জয়লাভ করবেন না। প্রথম ঈসায়ী জামাতের মধ্যে এই চিহ্ন দেখা দিয়েছে – হযরত পৌলকে একটি বিষাক্ত সাপ কামড়াল কিন্তু তার ক্ষতি হয়নি (প্রেরিত ২৮:৩-৯) এবং প্রথম জামাতের উদ্বোধনে ১২জন সাহাবী অলৌকিকভাবে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলছিলেন যখন পাক-রূহ্ তাদের উপর নেমে গেলেন। আমরা ইঞ্জিল শরীফ থেকে জানি যে বিভিন্ন ভাষা কথা বলার রূহানী দান সবাইকে দেওয়া হয়নি (১ করিন্থীয় ১২:১০); তেমনই ভাবে অন্যান্য চিহ্ন প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য নয়।

দ্বিতীয়ত, লোক দেখানোর জন্য আল্লাহ্ তাৎক্ষণিক কেরামতী করেন না। যখন মরুভূমিতে শয়তান হযরত ঈসার কাছে একটি “falsification test”-এর দাবী করলেন, ঈসা মসীহ্ কিতাবের তৌরাত শরীফের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তর দিলেন, “তোমার মাবুদ আল্লাহ্কে তুমি পরীক্ষা করতে যেয়ো না।” (মথি ৪:৭; মথি ১৬:৪)। আবার ইহুদী নেতারা যখন ঈসাকে একটি চিহ্ন দেখাতে বলল, তিনি তাদের কোন চিহ্ন দেখাতে চাননি। তিনি অবশ্যই অনেক চিহ্ন দেখাতে পারতেন (এবং অন্যান্য সময়ে তিনি প্রায়ই কেরামতী কাজ করতেন), কিন্তু লোক দেখানোর চিহ্ন করেননা। তেমনভাবেও হযরত মুহাম্মদের সমালোচকগণ তাকে একটি কেরামতী কাজ দেখাতে বলল, কিন্তু তিনি কখন তা করেননি। ঈসা মসীহ্র শিক্ষা অনুযায়ী, কেরামতী কাজ দ্বারা ঈমানদার এবং অ-ঈমানদার বোঝা যায় না, কারণ—

“…অনেক ভণ্ড মসীহ্ ও ভণ্ড নবী আসবে এবং বড় বড় চিহ্ন-কাজ ও কুদরতি দেখাবে যাতে সম্ভব হলে আল্লাহ্‌র বাছাই করা বান্দাদেরও তারা ঠকাতে পারে।” (মথি ২৪:২৪)

অর্থাৎ ঈসা মসীহ্ এই ধরণের ঈমানের পরীক্ষা সমর্থন করেননি।

তৃতীয়তঃ, “নতুন ভাষা” এবং “সব ভাষা” এক না। মার্ক ১৬:১৭ আয়াতে “καιναι” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার অর্থ “অজানা, নতুন”। অনেকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সেটা বোঝাচ্ছে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে তবলিগ করতে গিয়ে নতুন ভাষা শিক্ষার গুণ। অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এটা হচ্ছে একটি পুরোপুরি রূহানিক দান বা ‘বেহেশতি ভাষা’ যা আল্লাহ্ দান করেন।

মথি ২১:১২ – ঈসা মসীহ্‌ কোন্‌ দিনে বাইতুল মোকাদ্দসে গিয়েছিলেন?

মথি ২১:১২—“ঈসা মসীহ্‌ কোন্‌ দিনে বাইতুল মোকাদ্দসে বিক্রেতাদের তাড়িয়ে দিলেন—জেরুজালেমে ঢুকবার প্রথম দিনে (মথি ২১:১২) নাকি দ্বিতীয় দিনে (মার্ক ১১:১-১৭)?” এবং ডুমুর গাছটি তিনি কখন ধমক দিলেন? (দেখুন মার্ক ১১:১২)”

ঘটনাগুলো এই ক্রমে ঘটেছে:

প্রথম দিনে : ঈসা মসীহ্‌ একটি গাধার পিঠে করে জেরুজালেমে প্রবেশ করলেন, অল্পক্ষণের জন্য বাইতুল মোকাদ্দসে গেলেন, এবং সন্ধ্যায় আবার বেথানিয়া গ্রামে ফিরে গেলেন।

দ্বিতীয় দিন : ঈসা মসীহ্‌ ভোরে উঠে জেরুজালেমে যাওয়ার পথে ডুমুর গাছটিকে ধমক দিলেন, এবং তারপর বাইতুল মোকাদ্দসে বিক্রেতাদের তাড়িয়ে দিলেন।

মার্ক এবং লূকে এটা বেশ পরিষ্কার, কিন্তু মথি তার লেখায় বাইতুল মোকাদ্দসের ঘটনা রাখলেন জেরুজালেম প্রবেশ এবং ডুমুর গাছের ঘটনাগুলোর মাঝখানে। মথিতে এইভাবে আছে কারণ এই সমাচারে ঘটনাগুলো সাজানো হয়েছে প্রধানত বিষয় অনুসারে, সময়ের ক্রম অনুসারে নয়। অন্যান্য অনেক প্রাচীন লেখায় এইভাবে করা হয়। ঈসা মসীহ্‌র জেরুজালেম প্রবেশ এবং বাইতুল মোকাদ্দস পরিষ্কার করার ঘটনাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মথি এখানে দেখাতে চাচ্ছিলেন, যার কারণে তিনি মাঝখান থেকে ডুমুর গাছের ঘটনা সরিয়ে দিলেন।

মথি ২১:৭ – কয়টা গাধা?

মথি ২১:৭—“ঈসা মসীহ্‌ কি একটা গাধা ও গাধীর বাচ্চার পিঠে করে জেরুজালেমে প্রবেশ করলেন নাকি শুধু একটি গাধা ছিল যেমন মার্ক ১১:৭ এবং লূক ১৯:৩৫-এ আছে?”

মার্ক এবং লূক শুধু উল্লেখ করেছেন যে গাধীর বাচ্চা উপর ঈসা চড়ল, কিন্তু মথি এ-ও উল্লেখ করেছিলেন যে সেই গাধীর বাচ্চা শান্ত রাখার জন্য তার মা সঙ্গে করে নিয়ে নেয়া হল। জাকারিয়া ৯:৯ এর ভবিষ্যদ্বানী পূরণ করার জন্য ঈসা মসীহ্ ইচ্ছাকৃতভাবে গাধীর বাচ্চার উপরে চড়ে আসলেন।

মথি ১৬:১৭ – বেহেশত নাকি আন্দ্রিয়?

<h2 class=”objection”>মথি ১৬:১৭—“শিমোন পিতর কিভাবে জানতে পারলেন যে ঈসা ছিলেন সেই মসীহ্‌–সরাসরি বেহেশত থেকে, নাকি আন্দ্রিয়র মাধ্যমে (ইউহোন্না ১:৪১)?”</h2>
এটার ব্যাখ্যা বেশ সহজ—আন্দ্রিয় প্রথমে তাকে বলেছিলেন যে ঈসা ছিলেন মসীহ্, কিন্তু পিতর তার কথা তখন বিশ্বাস করেননি। পরে, হযরত ঈসার সঙ্গে সঙ্গে চলার পরে আল্লাহ্ তার অন্তরে প্রকাশ করলেন যে ঈসা সত্যই মসীহ্ ছিলেন। পিতরের আদর্শ খুব সুন্দর, কেমন করে একজন গ্রহণ করতে পারে যে সত্যই, ঈসা হচ্ছেন আল্লাহ্‌র সেই ওয়াদাকৃত এবং মনোনীত নাজাতদাতা।

ইউনুসের চহ্ন তিন দিন তিন রাত?

মথি ১২:৪০—(প্রথম প্রশ্ন) “ঈসা মসীহ বলেছিলেন যে তিনি কবরে তিন দিন এবং তিন রাত থাকবেন, কিন্তু তিনি করবে শুধু দুই রাত এবং পুরো এক দিন কবরে ছিলেন।”

ইঞ্জিলে বলা হয়নি যে ঈসা শুক্রবারে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন – বলা হয়েছে যে তিনি বিশ্রামবারের আগে “প্রস্তুতি দিবসে” ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। চলতি ধারণা ধরে নিয়েছে যে সেটা শুক্রবার, যেহেতু বিশ্রামবার সাধারণত শনিবারে হত। কিন্তু আসলে দুই ধরনের বিশ্রামবার হিল:

  1. সাপ্তাহিক সাধারণ বিশ্রামবার (সবসময় শনিবারে)
  2. “বিশেষ’ বা ‘মহাদিন’ বিশ্রামবারগুলো যেগুলো হিজরত ১২ ও লেবীয় ২৩ অধ্যায়ে বর্ণিত আছে; সেগুলো মসলমান ঈদের মত সপ্তাহের যেকোন দিনে পড়তে পারে।

ঈসা মসীহ কোন ধরনের বিশ্রামবারের আগে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন?…

মথি ১১:২ – ইয়াহিয়া ঈসাকে চিনতেন?

<h2 class=”objection”>মথি ১১:২—“তরিকাবন্দিদাতা ইয়াহিয়া এই ঘটনার আগে থেকেই ঈসাকে ‘মসীহ্‌’ হিসাবে চিনতেন (যেমন ইউহোন্না ১:৩২-৩৩), কিন্তু এই আয়াত অনুযায়ী তিনি তখনও মসীহ্‌কে চিনতে পারেননি।”</h2>
যখন ইয়াহিয়া নবী ঈসা মসীহ্কে তরিকাবন্দী দিয়েছিলেন, তিনি স্পষ্টভাবে দেখেছিলেন যে ঈসা সত্যই মসীহ্ ছিলেন। কিন্তু ইহুদী সমাজে সবাই চিন্তা করতেন যে মসীহ্ একজন রাজনৈতিক নেতা হবেন এবং সৈন্য নিয়ে রোমীয়দের তাড়িয়ে দিয়ে ইহুদীদের রাজনৈতিক মুক্তি লাভ করবেন। হযরত ইয়াহিয়া এরকম রাজনৈতিক উদ্ধার প্রত্যাশা করছিলেন, তাই এটা না দেখে তিনি একটু সন্দেহ করছিলেন।

মথি ১০:৯ – লাঠি ছিল?

মথি ১০:৯—“ঈসা মসীহ্‌ তার সাহাবীদের লাঠি আনতে অনুমতি দিয়েছিলেন (মার্ক ৬:৮) বা নিষেধ করেছিলেন (মথি ১০:৯)?”

ঈসা মসীহ্ তাদের বলেছিলেন যেন তারা নতুন লাঠি ‘জোগাড় করতে’ (κτήσησθε) সময় নষ্ট করে না, কিন্তু হাতের কাছে একটি থাকলে তা নিয়ে নেওয়ার অনুমতি ছিল। অর্থাৎ, যাত্রার জন্য বাড়তি জিনিসপত্র খোঁজে পাওয়ার দরকার ছিল না—তারা যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থায় যাওয়া উচিত, কোনো বাড়তি জিনিসপত্র কিনবেন না কারণ মাবুদ জোগাড় করবেন।

মথি ৯:১৮ – মেয়েটি মারা গেছে?

মথি ৯:১৮—“যায়ীর ঈসাকে কী বলেছিলেন – যে তার মেয়ে “এইমাত্র মারা গেছে” নাকি “মারা যাবার মত হয়েছে” (মার্ক ৫:২৩)?”

সম্ভবত যায়ীর উভয় কথাই বলেছিলেন— প্রথম “আমার মেয়ে মারা যাবার মত হয়েছে”, এবং এই কথা বলার পরপরই বাড়ী থেকে খবর আসল যে তার মেয়ে “এইমাত্র মারা গেছে”।

আবার হয়ত তিনি প্রথমে ঈসার কাছে স্বীকার করতে চাননি যে তার মেয়ে গারা গেলেন, যেন ঈসা চলে আসে। কিন্তু বলতে বলতে তিনি সাহস পেয়ে খুলাখুলিভাবে স্বীকার করলেন যে মেয়েটি মারা গিয়েছিলেন।

মথি ৪:১৮-২২ – গালীল সাগরের তীরে নাকি জর্দান নদীর কাছে?

মথি ৪:১৮-২২—“ঈসা মসীহের সঙ্গে পিতর ও আন্দ্রিয়ের প্রথম দেখা হয়েছে গালীল সাগরের তীরে নাকি জর্দান নদীর কাছে (ইউহোন্না ১:৪২-৪৩)?”

এই দুটি আয়াতে এমন কথা কোথাও স্পষ্টভাবে লেখা হয় নি যে এই সময় ছিল তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। সম্ভবত ইউহোন্নাতে এদের প্রথম সাক্ষাতের ঘটনার কথা বলা হয়েছে, এবং মথিতে গালীল সাগরের কাছে দ্বিতীয় সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে। নাহলে তো এমনভাবে অপরিচিত ব্যক্তিকে ডাকা অদ্ভুত হত যদি তাদের আগে থেকে সম্পর্ক না থাকত। জর্দান নদীর কাছে ঈসা মসীহ্ আগেই তাঁর চরিত্র, কুদরতী কাজ ও শিক্ষা তাদের কাছে দেখিয়েছিলেন, যার কারণে তারা পরে গালীল প্রদেশে বিনাপ্রশ্নে ঈসার ডাকে সারা দিয়েছিলেন।

মথি ৩:১৩-১৪ – তার তরিকাবন্দীর আগে ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঈসার সাক্ষাৎ হয়েছিলে?

মথি ৩:১৩-১৪—“তার তরিকাবন্দীর আগে ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঈসার সাক্ষাৎ হয়েছিলে নাকি হয়নি (ইউহোন্না ১:৩৩)?”

ঈসার তরিকাবন্দী পর্যন্ত, ইয়াহিয়া ঈসাকে চিনতেন শুধু অন্য শহরের একজন দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হিসেবে। তিনি হয়ত চিন্তা করতেন যে তিনি মসীহ্, কিন্তু পাক-রূহ্ যখন একটি কবুতরের মত হয়ে ঈসার উপর নেমে আসলেন তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলেন যে ঈসা সত্যিই আল্লাহ্‌র সেই ওয়াদাকৃত মসীহ্।