জেরুজালেমের দখল

ইউসা ১০:২৩,৪০—“এই আয়াত অনুযায়ী ইউসা এবং বনি-ইসরাইল জেরুজালেম শহর দখল করলেন, কিন্তু ইউসা ১৫:৬৩ অনুযায়ী তার তাই করেনি”

ইউসাতে আসলে বলা হয় নি যে এরা জেরুজালেম শহর দখল করলেন। ১০ অধ্যায়ে, জেরুজালেমের রাজা নবী ইউসার বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালিয়ে যুদ্ধে মারা গেলেন। নবী ইউসা তখন গিবিয়োন পর্যন্ত পুরো এলাকাটা ধ্বংস করলেন (জেরুজালেম না, কারণ সেটা এই নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে)। এর পরে ১৫ অধ্যায় থেকে আমরা জানতে পাই যে বনি-ইসরাইল সৈন্যদল জেরুজালেম থেকে যেবূষীয় লোকদের বের করতে পারেন নি, যার ফলে এরা যেবূষীয়দের সঙ্গে একটা চুক্তি করে তাদের সঙ্গে বসাবাস করতে লাগল।

সূর্য দাঁড়িয়ে গেল?

ইউসা ১০:১২-১৩—“সূর্য কীভাবে “দাঁড়াতে” পারেন”?

এই কাহিনী আসলে সাহীহ্‌ বোখারীতেও পাওয়া যায় –

আবূ হুরায়রা (রা) রাসূলুল্লাহ্‌ (ছ) থেকে যে সকল হাদীস আমাদের নিকট বর্ণনা করেছেন, এর মধ্যে এটি অন্যতম যে রাসূলুল্লাহ্‌ (ছ) বলেছেনঃ নবীদের মধ্যে কোন এক নবী জিহাদে রওয়ানা দিলেন … এরপর তিনি জিহাদে গমন করে আসরের নামাযের সময় কিংবা তার কাছাকাছি সময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রের নিকটবর্তী এক গ্রামে পৌঁছেন। তখন তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করে বলেন, তুমিও আদিষ্ট এবং আমিও আদিষ্ট। ইয়া আল্লাহ্‌!

অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা?

শুমারী ৫:১১-৩১—“তেঁতো পানির এই জেনার পরীক্ষা অবৈজ্ঞানিক নয়?”

আধুনিক দৃষ্টিতে এই পরীক্ষা অদ্ভুত, কিন্তু যারা আল্লাহ্‌র ক্ষমতা এবং কেরামতী বিশ্বাস করে তাদের কাছে এটার কোন সমস্য হওয়ার কথা না। এই তেঁতো পানি কোন রকম যাদু বা মানসিক কৌশল না, কারণ বার বার বলা হয়েছে যে এটা তার কাছে ক্ষতিকর হলে সেটা আল্লাহ্‌রই কাজ (১৬,২১,২৫ আয়াত)।

সাহীহ্‌ হাদীসের মধ্যে বেশ কিছু হাদীস আছে যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে যাদুর সমর্থন করে। বোখারী শরিফে বলা হয় যে চুল এবং পরাগ দিয়ে নবীজী (স)-এর উপর যাদু করা হয়েছে। সাহীহ্‌ মুসলিমে বলা হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (ছ) একজনকে ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি এবং উৎসাহ্‌ দেন। (সাহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং ৫৫৭৮)। হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ (ছ) তাঁকে [আয়েশাকে] বদ্‌ নজর লাগা থেকে রক্ষা পাওয়া জন্য ঝাড়-ফুঁক করার হুকুম করতেন (সাহীহ্‌ মুসলিম, হাদীস নং-৫৫৭১,৫৫৭৩)। সাহীহ্‌ বোখারী অনুযায়ী, “খারাপ স্বপ্ন দেখলে তার থেকে আশ্রয় চাইবে এবং নিজের বাম দিকে থুতু নিক্ষেপ করবে। তাহলে তার কোন ক্ষতি হবে না” (বোখারী হাদীস #৬৫০২)।

নারীদের তুচ্ছ?

লেবীয় ১২:১-৫—“ছেলে-শিশুর তুলনা মেয়ে-শিশুর বেলা মা দ্বিগুণ বেশী সময় নাপাক থাকে; তাতে নারীদের তুচ্ছ করা হয়।”

মেয়ে-শিশুদের ক্ষেত্রে আরও দীর্ঘক্ষণ ঘরে বিশ্রাম ককরার দুটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, হযরত মূসার শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী ছেলেদের জন্মের অষ্টম দিনে তাদের বাইতুল মোকাদ্দসে খৎনা করা হত, তাই ঘরের বাইরে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে হত। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য মা-শিশুদের এই বিশেষ বিশ্রামের ব্যবস্থা আসলে একটি আশীর্বাদ। আধুনিক বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী, জন্মের পর পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার জন্য কিছু সপ্তাহ্‌ বিশ্রাম করা খুব ভাল।

এই আয়াতগুলোতে নারীদের তুচ্ছ করার কোন ইঙ্গিত নাই; এর পরের আয়াতগুলোতে (৬-৮) বলা হয়েছে যে ছেলে-মেয়েদের কোরবানী ঠিক একই, অর্থাৎ তাদের মূল্য একই। সমালোচকদের ভুল যুক্তি এই আকিকাহ্‌র ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে, ইসলামী আকিকাহ্‌ নিয়ম অনুযায়ী ছেলেদের মূল্য দুটি ছাগল এবং মেয়েদের মূল্য মাত্র একটি ছাগল।

মনে রাখা উচিত যে হাদিসের পাক-নাপাকের নিয়মের মধ্যেও ছেলে-মেয়ে শিশুদের মধ্যে বৈষম্য করা হয়:

“আলী (রা) বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ্‌ (স) বলেছেন: ছেলেশিশুর প্রস্রাবের উপর একটু পানি ছিটিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু মেয়েশিশুর প্রস্রাব ধুয়ে দিতে হবে।”

এতে যদি মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হয় না তাহলে লেবীয় ১২তেও মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হচ্ছে না।

    ১.

নারী বীর্য?

লেবীয় ১২:১—“এই আয়াতে ভুল আছে যে নারী বীর্য উৎপাদন করে”

কিছু সমালোচক দাবী করেছেন যে বাংলায় যেখানে “গর্ভবতী হয়” অনুবাদ হয়েছে তার পিছনে যে হিব্রু ক্রিয়াশব্দ আছে זָרַע তাজ্‌রিয়া তার অর্থ “বীজ উৎপাদন করা” অর্থাৎ বীর্য উৎপাদন করা যা বৈজ্ঞানিক ভুল। কিন্তু এটা তো সত্য, মেয়েদের অণ্ডাশয়ের মধ্যে যখন অন্ড হয় সেটা অবশ্যই ‘বীজ’ বলা যায় যতটুকু বীর্য ‘বীজ’ বলা যায়। এর মধ্যে তো কোন বৈজ্ঞানিক সমস্যা নাই।

প্রজনন নিয়ে কোরআনেরও কিছু জটিলতা আছে, কারণ সূরা তারিকে বলা হয়েছে:

“তাহাকে [মানুষকে] সৃষ্টি করা হইয়াছে সবেগে স্খলিত পানি হইতে,
ইহা নির্গত হয় মেরুদণ্ড ও পিঞ্জরা স্থির মধ্য হইতে” (সূরা তারিক ৮৬:৬,৭)

আগের যুগে মানুষ বিশ্বাস করত যে পিঠ বা বৃক্ক থেকে বীর্য আসে, কিন্তু বর্তমানে আমরা জানি বীর্য অণ্ডকোষের শুক্রাশয় থেকেই আসে। বর্তমান বিজ্ঞানের তথ্যের সঙ্গে এটা মিলানোর জন্য সাতটি আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

ফড়িংয়ের কয়টা পা?

লেবীয় ১১:২১-২৩—“ফড়িংয়ের মত পোকাদের চার পা নয় বরং ছয় পা”

এটা আবার শুধুমাত্র অনুবাদসংক্রান্ত সমস্যা। উপরোক্ত ফড়িংদের চারটি সাধারণ পা আছে এবং লাফ দেওয়ার জন্য দু’টি অন্য রকম বড় পা। প্রাচীন কালে এগুলো হাটার পা হিসেবে গণ্য হত না, তাই এগুলোকে ‘চার-পা বিশিষ্ট’ পোকা বলা হত। আবার ‘চার পায়ে হাটা’ দিয়ে বোঝানো হত চার বা চারেরও বেশী পায়ের পোকা যেমন কীট এবং কেন্নো।

খরগোশ জাবর কাটে না

লেবীয় ১১:৫,৬—“খরগোশ এবং শাফন জাবর কাটে না”

এটা শুধুমাত্র অনুবাদের সমস্যা। বাংলায় যা অনুবাদ হয়েছে ‘জাবর কাটা’ হিব্রু ভাষায় তা হয় עָלָה גֵּרָה ‘আলাহ্‌ গেরাহ্‌ । এই শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় গরু, ছাগল, ভেড়া, খরগোশ এবং শাফন যেভাবে আস্তে আস্তে তাদের খাবার দ্বিতীয় বার ছিবিয়ে খায়। আসলে খরগোশ এবং শাফন সত্যই এইভাবে করে। গরু-ভেড়ার মত করে তারা পেট থেকে সরাসরি খাবার ফিরে আনে না বরং সেটা পায়খানা করে আবার সেই পায়খানা দ্বিতীয়বার খায় যেন যা যা ঠিকমত হজম হয় নি সেটা আবার হজম করা যায়। এটা ইংরেজিতে বলা হয় refection। গরু-ছাগল পেট থেকে খাবার আবার সরাসরি মুখে এনে দ্বিতীয় বার তা ছিবিয়ে খায়, এবং সেটাকে ইংরেজিতে বলা হয় rumination

হিব্রু শব্দ ‘আলাহ্‌ গেরাহ্‌ দিয়ে বোঝানো হয় উভয় সম্পর্কিত জিনিস, refection এবং rumination। শুধুমাত্র আধুনিক যুগে এই দুই জিনিসের পার্থক্য বোঝা গেল। কিতাবগুলো টেক্‌নিকাল পরিভাষায় তো লেখা হয় নি, না হলে কোরআন এবং তওরাতে লেখা থাকত না “সূর্যোদয়” এবং “সূর্যাস্ত”। টেক্‌নিকাল অর্থে এটাও আবার ‘ভুল’, কারণ সূর্য ডুবে না বা উঠে না বরং পৃথিবী শুধু ঘুরছে।

কোরআন শরীফের ক্ষেত্রেও আয়াতগুলো অত আক্ষরিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। সূরা যারিয়াতে লেখা আছে:

“আর প্রত্যেক বস্তু আমি সৃষ্টি করিয়াছি জোড়ায় জোড়ায়, যাহাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা যারিয়াতে ৫১:৪৯)

কিন্তু কিছু কিছু প্রাণী আছে যেগুলোর স্ত্রী-পুরুষ লিঙ্গ নেই, যেমন নিউ মেক্সিকো ওয়িপ্‌টেইল লিজার্ডের (Cnemidophorus neomexicanus ) মত বেশ কিছু লিজার্ড প্রজাতি শুধু স্ত্রীলিঙ্গে হয় এবং নিজে নিজে গর্ভোৎপাদন করে ডিম পারে। আবার আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী একটি খুব ব্যাপক ছাতলা প্রজাতি আছে ( Schizophyllum commune ) যার অনেক বেশী লিঙ্গ আছে। এতে আমি কোরআনের সমালোচনা করছি না বরং শুধু দেখাচ্ছি যে কিতাব সবসময় আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

পিতার জন্য পুত্র দোষী?

হিজরত ২০:৫-৬—“পিতার গুনাহের জন্য সন্তানকে দায়ী করা অন্যায়”

শুরুতেই বলতে হয় যে তওরাতের শরিয়তের স্পষ্ট শিক্ষা হল যে রাষ্ট্রীয় আইনের ক্ষেত্রে এবং কেয়ামতের বিচারের ক্ষেত্রে কোন মানুষ তার পিতার গুনাহের জন্য দোষী করা হবে না:শ

রাস্ট্রীয় আইন:

“ছেলেমেয়েদের গুনাহের জন্য বাবাকে কিংবা বাবার গুনাহের জন্য ছেলেমেয়েদের হত্যা করা চলবে না। প্রত্যেককেই তার নিজের গুনাহের জন্য মরতে হবে।” (দ্বিতীয়বিবরণ ২৪:১৬)

কেয়ামতের বিচার: “যে গুনাহ্ করবে সে-ই মরবে। ছেলে বাবার দোষের জন্য শাস্তি পাবে না আর বাবাও ছেলের দোষের জন্য শাস্তি পাবে না। সৎ লোক তার সততার ফল পাবে এবং দুষ্ট লোক তার দুষ্টতার ফল পাবে।” (ইহিষ্কেল ১৮:২০)

প্রাচীন চীন এবং মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ম অনুযায়ী, একজন পিতার পাপের জন্য পুত্রকে শাস্তি দেওয়া যেত, তাই সেই সময়ের জন্য এটি খুব অগ্রগামী নিয়ম ছিল।

তাহলে হিজরত ২০:৫-৬ আয়াত কীভাবে আমরা ব্যাখ্যা করব?…

রংধনুর সৃষ্টি

পয়দায়েশ ৯:১৩—“বৈজ্ঞানিক দিক থেকে সেটা সম্ভব না যে শুধুমাত্র মহাবন্যার পরে আল্লাহ্‌ রংধনু সৃষ্টি করেছেন”

কিতাবুল মোকাদ্দসে তো কিন্তু কোন ইঙ্গিত নাই যে বন্যার আগে রংধনু ছিল না; অবশ্যই তা আগে থেকেই ছিল। আল্লাহ্‌ হযরত নূহ্‌কে বরং বলেছিলেন যে সেটা তার কাছে আল্লাহ্‌র প্রতিজ্ঞা মনে রাখার জন্য একটি বিশেষ চিহ্ন হবে যে তিনি আবার দুনিয়া সেভাবে ধ্বংস করবে না। তেমনই ভাবে পয়দায়েশ ১৫ অধ্যায়ে আল্লাহ্‌ হযরত ইবরাহিমকে তারা দেখিয়ে বলল যে সেটা তার জন্য একটি চিহ্ন হবে কত বংশধর তাকে দেওয়া হবে। তাতে কি আমরা বুঝবো যে তারাগুলো শুধু তখনই সৃষ্টি হয়েছিল?…

বিশ্বব্যাপী বন্যা?

পয়দায়েশ ৭—“এখানে বলা হয়েছে যে মহাবন্যার পানি পুরো দুনিয়া ঢেকে ফেলেছে, কিন্তু বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী এটা অসম্ভব”

যারা এই রকম সমালোচনা করে তারা হয়ত জানে না যে ইতিহাস জুড়ে কোরআনের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারীরা একইভাবে কোরআন শরীফও ব্যাখ্যা করেছেন যে হযরত নূহের মহাবন্যা সর্বজনীন। ইবনে আব্বাস, ইবন কাসীর এবং আত-তাবারী সকলই কোরআন শরীফ এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা এইভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কারণ কোরআন শরীফ এইভাবে বলে:

“নূহ্‌ আরও বলিয়াছিল, ‘হে আমার প্রতিপালক!’