ইয়াহিয়া ও ঈসা মসীহ হওয়ার বিশষত্ব কী?

১। বাইবেলে আদমকে ঈশ্বরপুত্র বলা হয়েছে, দাউদকে ঈশ্বরপুত্র বলা হয়েছে, সুলায়মানকে ঈশ্বরপুত্র বলা হয়েছে তথাপি যারা ঈশ্বরের আত্মার সাহায্যে পরিচালিত হয় বা ঈশ্বরের ইচ্চা পূরণ করে তাদের কে ঈশ্বরপুত্র বলা হয়েছে। তাহলে ঈসা মসীহ ঈশ্বরপুত্র পরিচয়ের বিশেষ মাহাত্ম্য কী?

ভালো প্রশ্ন। সংক্ষিপ্ত উত্তর হল যে ঈসা মসীহের মাহাত্ম শুধু ‘আল্লাহর পুত্র’ হওয়ার উপর নির্ভর করে না, তার মাহাত্ম্যের আরও অনেক কিছু আছে। তাই নিচের আলোচনায় আমি কিছু প্রমাণ করার জন্য লিখছি না বরং কিতাবের সঠিক ব্যাখ্যা দেখানোর জন্য লিখছি।

তওরাত, জবুর ও নবীদের কিতাবে ‘আল্লাহর সন্তান’

প্রথমে ইঞ্জিলের আগেকার কিতাবে ‘আল্লাহর সন্তান’ কথাটার ব্যবহার একটু দেখি। প্রথমে আমরা দেখি যে এটা কোন সাধারণ উপাধি নয়; এটা শুধু ধার্মিক ও আল্লাহর আত্মায় পরিচালিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় না। শত শত ধার্মিক ব্যক্তি আছে ইঞ্জিলের আগেকার কিতাবে, কিন্তু শুধুমাত্র বিশেষ কয়েকজনের ক্ষেত্রে এটা ব্যবহার হয়েছে:

  1. ১. হযরত আদম – এটা আসলে শুধু একবার ইঞ্জিলে (লূক ৩:৩৮) ব্যবহার হয়েছে একটি বংশতালিকার মধ্যে, কারণ সবাই ‘অমুকের সন্তান’ লেখার পরে লিখতে হয়েছে ‘আদম আল্লাহর সন্তান’। এর অর্থ হল যে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে এবং তিনি আল্লাহ্‌ সূরতে সৃষ্টি। (দেখুন পয়দায়েশ ৫:১-৩)
  2. ২. আল্লাহর বিশেষ মনোনীত ব্যক্তি বা জাতি – আল্লাহ হযরত দাউদকে একটি বিশেষ প্রতিজ্ঞা বা চুক্তি দিয়েছে যে তাঁর বংশধর রাজত্ব করবে এবং সেই বাদশাহ আল্লাহর সন্তানের মত হবে (২ শামুয়েল ৭:১৪)। এটা কিছুটা পূরণ হয়েছে সোলায়মানের মধ্যে কিন্তু মূলত পূরণ হয়েছে ঈসা মসীহের মধ্যে। এইজন্য ইহুদিরা যে মসীহের জন্য অপেক্ষা করেছিলেন তার অপর নাম ছিল “আল্লাহ্‌ সন্তান” বা “দাউদের সন্তান” — তারা এই প্রতিজ্ঞার কথা চিন্তা করেছিলেন।
  3. ৩. বনি-ইসরাইল – বনি-ইসরাইলকেও আল্লাহ তার ‘সন্তান’ বলেছে, যেমন হোসিয়া ১১:১-৪: “মাবুদ বলছেন, “ইসরাইলের ছেলেবেলায় আমি তাকে মহব্বত করতাম এবং মিসর থেকে আমার ছেলেকে ডেকে এনেছিলাম।”

তৌরাত, জবুর ও নবিদের কিতাবে অনেক নবি ছিল যারা আল্লাহর আত্মায় পরিচালিত কিন্তু তাদের কাউকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলা হয়নি – যেমন হযরত নুহ, ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, মূসা, ইউসা, কালুত, শামুয়েল, ইলিয়াস, আল-ইয়াসা, ইত্যাদি। তাই আমার মনে হয় না যে এটা সাধারণ একটি উপাধি ছিল।

ইঞ্জিল শরিফ

ইঞ্জিলের আগেকার কিতাবে ‘আল্লাহর সন্তান’ যতবার ব্যবহার হয়েছে সেটা ঈসা মসীহর ক্ষেত্রে অনেক বেশি বার বলা হয়েছে, এবং আমরা বুঝতে পারি যে তিনি বিভিন্ন দিক দিয়ে ‘বিশেষভাবে’ আল্লাহর সন্তান ছিল:

  • মনোনীত – দাউদ, সোলায়মান ও ইসরাইল জাতি মনোনীত উদ্ধারকর্তার জন্য পথ প্রস্তুত করছিল, কিন্তু ঈসা মসীহ নিজেই সেই মনোনীত নাজাতদাতা ছিল। ২ শামুয়েলে যেখানে দাউদ ও সোলায়মানকে আল্লাহর পুত্র বলা হয়, সেই ভবিষ্যদ্বানীর পূর্ণতা হল ঈসা মসীহ
  • বাধ্যতায় – ইঞ্জিলে আছে: “সেই ইহুদি নেতারা ঈসাকে বললেন, “ইব্রাহিমই আমাদের পিতা।” ঈসা তাঁদের বললেন, “যদি আপনারা ইব্রাহিমের সন্তান হতেন তবে ইব্রাহিমের মতই কাজ করতেন… ইবলিসই আপনাদের পিতা আর আপনারা তারই সন্তান; সেইজন্য আপনারা তার ইচ্ছা পূর্ণ করতে চান।” (ইউহোন্না ৮:৩৯) অর্থাৎ ঈসার কথা অনুযায়ী ‘আল্লাহর সন্তান’ বোঝায় যারা আল্লাহর ইচ্ছামত কাজ করে। যেহেতু একমাত্র ঈসা মসীহ সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ছিল, চারিত্রিক দিকে তিনি আলাদা স্তরে ‘আল্লাহর সন্তান’। ইঞ্জিলে আরও আছে: “যে গুনাহ্ করতেই থাকে সে ইবলিসের কারণ ইবলিস প্রথম থেকেই গুনাহ্ করে চলেছে।”

ঈসায়ীরা ‘আল্লাহর সন্তান’

কিন্তু ইঞ্জিল অনযায়ী যারা ঈসা মসীহের উপর ঈমান আনে তাদের ‘আল্লাহর সন্তান’ হওয়ার অধিকার পায়। এই ‘সন্তান’ হওয়ার অধিকার মসীহের উপর নির্ভরশীল:

“মসীহ ঈসার উপর ঈমানের মধ্য দিয়ে তোমরা সবাই আল্লাহর সন্তান হয়েছ” (গালাতীয় ৩:২৬)

আমরা যে আল্লাহর সন্তান সেটা বোঝায়:

  • পিতার ভালোবাসার পাত্র – আমরা অযোগ্য হলেও আল্লাহ্‌ একজন উত্তম প্রেমি পিতার মত করে আমাদের মহব্বত করে। অবশ্যই তিনি সকল মানুষকে ভালোবাসে, কিন্তু মসীহের মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর ভালোবাসা বিশেষভাবে জানতে পারি।
  • শাসন – এই ভালোবাসার মধ্যে শাসনও আছে: “তোমরা এই সব কষ্ট শাসন হিসাবে ভোগ করছ। আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি পিতার মতই ব্যবহার করছেন। এমন ছেলে কি কেউ আছে যাকে তার বাবা শাসন করেন না?” (ইবরানী ১২:৮)
  • উত্তরাধিকার – গোলাম উত্তরাধিকার পায় না, কিন্তু সন্তান পায়। “আমরা যদি সন্তানই হয়ে থাকি তবে আল্লাহ্ তাঁর সন্তানদের যা দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন আমরা তা পাব” (রোমীয় ৮:১৭) “গোলাম চিরদিন বাড়ীতে থাকে না কিন্তু পুত্র চিরকাল থাকে।” (ইউহোন্না ৮:৩৫)
  • আদর্শ – গোলাম বেতনের জন্য কাজ করে, কিন্তু সন্তানের লক্ষ্য হল তার পিতার মত হওয়া। ঈসা বলেছিলেন, “ধন্য তারা, যারা লোকদের জীবনে শান্তি আনবার জন্য পরিশ্রম করে, কারণ আল্লাহ্ তাদের নিজের সন্তান বলে ডাকবেন” (মথি ৫:৯)। এখানে সন্তান হওয়া মানে তার আদর্শে চলা।

২। বাইবেলে দাউদকে মসীহ বলা হচ্ছে, এমনকি অনেক অত্যাচারী শাসক ও রাজাকেও মসীহ বলা হয়েছে তাহলে ঈসার সাথে মসীহ উপাধির বিশেষ মাহাত্ম্য কী? মসীহ অর্থ যদি অভিষিক্ত হয় তাহলে প্রত্যেক নবীই তো ঈশ্বরের দ্বারা অভিষিক্ত তাহলে প্রত্যেক নবীই কি মসিহ নয়?

কিছু শব্দ আছে যার আক্ষরিক অর্থ এক কিন্তু ঐতিহাসিক ব্যবহারের কারণে অন্য একটি অর্থ ধারণ করে। যেমন ‘বাইবেল’ এর মূল (etymological) অর্থ শুধু ‘বই’ এবং ‘কোরআন’ এর মূল অর্থ শুধু শুধু ‘আবৃত্তি’, কিন্তু আসলে এই শব্দগুলোর অর্থ অতো সহজ না। ‘কোরআন’ বিশেষ একটি আবৃত্তি বোঝায়, এবং বাইবেল বিশেষ একটি বই বোঝায়। ‘মসীহ’ শব্দ একই রকম। এর সাধারণ অর্থ শুধু ‘অভিষিক্ত’ বা ‘মনোনীত’, এবং এই অর্থে দাউদসহ অন্যান্য ব্যক্তি আল্লাহর বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য অভিষিক্ত বা মনোনীত হতে পারে।

কিন্তু ‘মসীহ’ এর বিশেষ অর্থ কী? তৌরাত, জবুর ও ইঞ্জিল জুড়ে বার বার বলা হচ্ছে যে একজন ব্যক্তি আসবে যার মাধ্যমে পাপের সমাধান আসবে। তিনি শয়তানের কাজ ধ্বংস করবে (পয়দায়েশ ৩:১৫), তার মধ্য দিয়ে সমস্ত জাতি দোয়া পাবে (পয়দায়েশ ১২:৩), তিনি চিরকাল রাজত্ব করবে (২ শামুয়েল ৭:১৪), বেথলেহেম গ্রামে তার জন্ম হবে (মিকাহ ৫:২), তিনি আমাদের গুনাহ দূর করবে (ইশাইয়া ৫৩, ইয়ারমিয়া ৩১:৩৪), ইত্যাদি। এইসব ভবিষদ্বানীর ভিত্তিতে ইহুদিরা ‘মসীহ’ এর জন্য অপেক্ষা করছিল শত শত বছর ধরে। যে ব্যক্তি এইসব ভবিষদ্বানী পূরণ করে তিনিই সেই ‘মসীহ’।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: ‘মসীহ’ ব্যবহার হয় “ঈসা” নামের সঙ্গে – “ঈসা মসীহ”। “ঈসা” নামটা ফেরেশতা জিব্রাইল দিয়েছে “তুমি তাঁর নাম ঈসা রাখবে, কারণ তিনি তাঁর লোকদের তাদের গুনাহ্ থেকে নাজাত করবেন” (মথি ১:২১)। ঈসা মানে “নাজাতদাতা”; তাই “ঈসা মসীহ” মানে মনোনীত নাজাতদাতা”। দাউদসহ অন্যান্য ব্যক্তি মনোনীত ছিল বিভিন্ন কাজের জন্য, কিন্তু ঈসা ছাড়া আল্লাহ কাউকে নাজাত দেওয়ার জন্য “মনোনীত” করেননি।

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Comments are closed.