দ্বিঃবিঃ ১৮ – হযরত মূসার মত একজন নবী

তৌরাত শরীফের দ্বিতীয় বিবরণ ১৮ অধ্যায়

অধিকাংশ বাইবেল বিশেষজ্ঞরা একমত যে, দ্বিতীয় বিবরণে উল্লেখিত ভবিষ্যদ্বানীটিতে ঈসা মসীহের কথা বলা হচ্ছে। শুধু খ্রীষ্টানরাই নয়, এমনকি হযরত ঈসা মসীহের জন্মেরও শত বছর আগে থেকেই ইহুদীগণ মনে করতেন যে এই আয়াতে তাদের সেই আসন্ন “মসীহ্‌” ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ইদানিং কালে কিছু ইসলামিক টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলোতে দাবি করা হচ্ছে যে, দ্বিতীয় বিবরণের এই ভবিষ্যদ্বানীটি ঈসা মসীহ্‌কে নিয়ে নয় বরং হযরত মোহাম্মদের (স) বিষয়ে করা হয়েছে:

১৫”তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্ তোমাদের মধ্য থেকে, তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন। তাঁর কথামত তোমাদের চলতে হবে। ১৬তুর পাহাড়ের কাছে যেদিন তোমরা সবাই মাবুদের সামনে জমায়েত হয়েছিলে সেই দিন তোমরা তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কাছে তা-ই চেয়েছিলে। তোমরা বলেছিলে, ‘আর আমরা আমাদের মাবুদ আল্লাহ্‌র কথা শুনতে কিংবা এই মহান আগুন দেখতে চাই না; তা হলে আমরা মারা যাব।’

১৭“মাবুদ আমাকে বলেছিলেন, ‘তারা ভালই বলেছে। ১৮আমি তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তাদের জন্য তোমার মত একজন নবী দাঁড় করাব। তার মুখ দিয়েই আমি আমার কথা বলব, আর আমি যা বলতে তাকে হুকুম দেব সে তা-ই তাদের বলবে। ১৯সেই নবী আমার নাম করে যে কথা বলবে কেউ যদি আমার সেই কথা না শোনে, তবে আমি নিজেই সেই লোককে দায়ী করব।”
(তৌরাত শরীফ, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫-১৯)

তবে এই ভবিষ্যদ্বানীটিতে সঠিক নবীকে চিনে নেবার জন্য তিনটি প্রাথমিক শর্ত দেওয়া হয়েছে:

১. তোমাদের জন্য

[সকল বনি ইসরাইলদের বুঝাচ্ছেন]
২. তোমাদের নিজেদের ভাইদের মধ্য থেকে।
৩. মূসার মতো একজন নবী

 

 

প্রথম শর্ত : “তোমাদের জন্য” একজন

“তোমাদের মধ্য থেকে, তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন।” (দ্বিঃবিঃ ১৮:১৫)

মূসা এখানে পরিষ্কারভাবে মরূভুমিতে বসবাসরত বনি ইসরাইলেয়ীদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছেন। যদিও ঈসা নবী ও হযরত মুহাম্মদ (সঃ) দুজনেই দাবি করেছেন যে তাদের ধর্মীয়শিক্ষা সমগ্র মানব জাতির জন্য, তবুও ঈসা নবীর প্রাথমিক তবলীগ প্রধানত বনি ইসরাইলদের মধ্যে এবং হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর তবলীগ প্রধানত আরবদের কেন্দ্র করে ছিল।

দ্বিতীয় শর্ত : “তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকে” একজন

তোমাদের মধ্য থেকে, তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন।” (দ্বিঃবিঃ ১৮:১৬)

মিসরীয়দের হাত থেকে মুক্ত করার পরে চল্লিশ বছর ধরে মূসা বনি ইসরাইলদের মরুভূমিতে পরিচালিত করেছিলেন। মূসা এখানে ময়াব অঞ্চলে অবস্থানরত বনি ইসরাইলদের উদ্দেশ্য করেই যখন এই কথাগুলো বলছিলেন তখন আমরা সহজেই মনে করে নিতে পারি যে “তোমাদের নিজেদের ভাইদের মধ্য হতে” বলতে তিনি বনি ইসরাইল জাতির মধ্য থেকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু নায়েক ও দিদাত এই সহজ অর্থ এড়িয়ে গিয়ে বলেন যে, “ভাই” এখানে হতে পারে দূর-সম্পর্কীয় অন্যান্য সেমিটিয় গোষ্ঠী, যেমন আরব জাতি। কিন্তু এই ভবিষ্যদ্বানীতে “ভাই”-অনূদিত যে মূল হিব্রু শব্দ তৌরাত শরীফে আছে “আখ্‌” (אח , আরবীতে اَخ), সেটার অর্থের দ্বারা কোন দূর-সম্পর্কীয় গোষ্ঠীর লোককে বোঝানো যায় না । “আখ্‌” বলতে বোঝায় শুধুমাত্র আপন ভ্রাতা অথবা একই গোত্রের সদস্য। প্রসিদ্ধ মুসলিম কোরআন অনুবাদক মোহাম্মদ হামিদুল্লাহ সম্মতি প্রকাশ করে বলেছেন যে “আরবীয় শব্দ “আখ” বোঝায় আপন ভাই এনং একই গোষ্ঠির সদস্য।”

আরেকটি আয়াতের সাথে তুলনা করলেই এই ব্যাখ্যার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিবরণের ১৭ অধ্যায়ের ১৫ আয়াতে বলা হয়েছে:

“যে তোমাদের ভাই (אח) নয় এমন ভিন্ন জাতির কোন লোককে তোমরা তোমাদের বাদশাহ্করবে না।” (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:১৫)

এই আয়াত দেখে বোঝা যায় যে “তোমার ভাই (אח)-দের মধ্য থেকে একজন” অবশ্যই বোঝানো হত একজন ইসরাইলীয় ব্যক্তিকে, অন্য কোন জাতিকে নয়। আসলে বনি ইসরাইলদের আশে-পাশে অনেক জাতিগুলো আরবদের মতই সেমিটিয় ইবরাহিম-বংশোদ্ভূত গোষ্ঠী ছিলেন (যেমন মোয়াবীয়রা, ইদোমীয়, ইত্যাদি)। শুধু এই দূর-সম্পর্কের কারণে কি বলা যায় যে সেকালীন সেমিটীয় জাতি থেকে এই নবী আসতে পারত? এই ভবিষ্যদ্বানী নাজিল হওয়ার সময়ে বনী-ইসরাইল প্রায় ৫০০ বছর ধরে ইসমাইলের বংশধরদের থেকে পুরোপুরি আলাদা জাতিতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা ৪০০ বছর ধরে আলাদা মহাদেশে বসবাস করেছিল, এবং মূসার সময়ে আলাদা ভাষা ব্যবহার করতো। তেমনই ভাবে বাঙালি ও আফগানিদের দু’জনেরই আর্য পূর্বপুরুষ আছে বটে, কিন্তু “গোষ্ঠীর ভাই” কখনও একজন বাঙ্গালির কাছে কোন আফগানীকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা যাবে না।

এইভাবে আমাদের মানতেই হবে যে, “তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকে” বলতে বনী-ইসরাইলদের বারোটি গোষ্ঠীর ভিতর থেকেই একজনকে বোঝানো হচ্ছে, অন্য কোন দূর-সম্পর্কীয় জাতির মধ্য থেকে নয়। যেহেতু হযরত মুহাম্মদ(সঃ) একজন ইসরাইলীয় ছিলেন না, সেহেতু বলতে হয় যে এখানে তাঁর কথা বলা হচ্ছে না।

তৃতীয় শর্ত: হযরত মূসা (আঃ)-এর মত একজন

“তোমাদের মধ্য থেকে, তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন।” (দ্বিঃবিঃ ১৮:১৫)

এই ভবিষ্যদ্বানীটি যে হযরত মুহাম্মদ(সঃ)-এর (ঈসা নবীর নয়), তা প্রমাণ করার জন্য নায়েক ও দিদাত হযরত মুহাম্মদ(সঃ) ও হযরত মূসার মধ্যেকার বিভিন্ন সাদৃশ্যের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন :

১. হযরত মুহাম্মদ এবং মূসা দুজনেই একটি শরীয়ত প্রণয়ন করেছেন, তবে ঈসা তা করেননি।২. হযরত মুহাম্মদ এবং মূসা দুজনেরই জন্ম জাগতিক পিতার মাধ্যমে হয়েছিল; কিন্তু ঈসার কোন জাগতিক পিতা ছিলেন না।৩. হযরত মুহাম্মদ এবং মূসা দুজনেই বিবাহিত ছিলেন; ঈসা বিবাহ করেননি।

৪. হযরত মুহাম্মদ ও মূসা দুজনই তাদের নিজ গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক নেতা ছিলেন; ঈসা তা ছিলেন না।

৫. দুই নবীই আল্লাহর নির্দেশে তাদের সময় থেকে মাস গণনা আরম্ভ করেছিলেন।

৬. হযরত মুহাম্মদ ও হযরত মূসা দুজনেই তাদের জীবনকালে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে বেড়িয়েছেন এবং দুজনেই তাদের শ্বশুড়দের কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন।

৭. মুহাম্মদ ও মূসা দুজনেরই স্বভাবিক মৃত্যু ঘটেছে।

অন্যান্য তর্কবিদরাও আরও কিছু সাদৃশ্য দেখিয়েছেন যেগুলো আসলে ভুল প্রমাণিত হয়েছে:

– হযরত মুহাম্মদ ও মূসা দুজনেই একটি নির্দিষ্ট জায়গা তাদের শাসনাধীনে এনেছিলেন (ভুল: মূসা কেনান দেশে ঢুকবার ঠিক আগেই মারা গিয়েছিলেন এবং পরে হযরত ইউসা তা জয় করেন)- হযরত মুহাম্মদ ও মূসা দুজনেই মিদিয়ান নামক একটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। মিদিয়ান পরে ইয়াথরিব এবং তার পরে মদিনা নামে পরিচিতি লাভ করে। (ভুল: মিদিয়ান মদিনা থেকে ৪০০ মাইল দূরে অবস্থিত)- হযরত মুহাম্মদ ও মূসা দুজনেই মদিনায়/মিদিয়ানে ১০ বছর তবলীগ করেছেন (ভুল: মিদিয়ানের মরু এলাকায় মূসা ৪০ বছর ধরে শুধু ভেড়াদের রাখাল হিসেবে কাজ করেছেন- আল্লাহ তাকে পরে তবলীগ কাজে ডেকেছিলেন)

তাহলে আমরা দেখি যে মুহাম্মদ ও মূসার মধ্যে সাতটি সাদৃশ্য তুলে ধরা যায়। লক্ষ করুন কীভাবে এই সাদৃশ্যগুলো (সাধারন জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, নিয়ম প্রণয়ণ এবং রাজ্য দখল) প্রায় যেকোনো নেতার দ্বারাই পূর্ণ করা সম্ভব।

আমরা ঠিক একইভাবে খুব সহজেই দাউদ নবী ও মূসা নবীর মধ্যেও ৯টি সাধারণ সাদৃশ্য বের করতে পারি:

১. রাজনৈতিক নেতৃত্ব
২. স্বাভাবিক জন্ম
৩. বহু বিবাহ
৪. স্বাভাবিক মৃত্যু
৫. সন্তানের পিতা
৬. বনি-ইসরাইল বংশে
৭. কেনানীয়দের জমি শাসনাধীনে আনা
৮. তাদের উপরে কিতাব নাজিল হয়েছে
৯. আল্লাহ্‌র বিশেষ ওয়াদা-প্রাপ্ত

তেমনইভাবে হযরত সোলায়মান (আঃ) ও মূসার মধ্যে এই ধরণের অগভীর ৮টি সাদৃশ্য দেখা যায়:

১. রাজনৈতিক নেতৃত্ব
২. স্বাভাবিক জন্ম
৩. বহু বিবাহ
৪. স্বাভাবিক মৃত্যু
৫. সন্তানের পিতা
৬. বনি-ইসরাইল বংশে
৭. কেনানীয়দের জমি শাসনাধীনে আনা
৮. তাদের উপরে কিতাব নাজিল হয়েছে

এমনকী সাবেক বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ডঃ ফখরুদ্দীন আহমেদ এরও মূসা নবীর সাথে-স্বাভাবিক জন্ম, বিবাহিত, সন্তানদের পিতা, তাদের নিজেদের গোষ্ঠির নেতার মতো ইত্যাদি অনেক মিল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এইভাবে দেখা যায় যে, এই ধরণের সাধারণ “সাদৃশ্য” দ্বারা আসলে কিছুই প্রমান হবার নয়।

“মূসার মত” সেই নবীকে চিনে নিতে হলে এইসব অগভীর সাদৃশ্যের পরিবর্তে মূসা নবীর মূল কাজ এবং তার অনন্য বৈশিষ্ট্য দেখতে হবে। আমরা যদি মূসা নবীর সমস্ত ঘটনা তৌরাত কিতাব থেকে পড়ি, তাহলে আমরা দেখতে পাই যে মূসা নবীর কিছু অদ্বিতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেবল ঈসা নবীর জীবনেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে— দাউদ, সোলায়মান অথবা মুহাম্মদের জীবনে নয়:

প্রথম বিশেষ বৈশিষ্ট্য: একজন উদ্ধারকর্তা

মূসা নবী আল্লাহর লোকদের মিসর দেশের জাগতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর ওয়াদাকৃত সেই শান্তির দেশে বনি ইসরাইলদের নিয়ে গিয়েছিলেন। এটাই ছিল হযরত মূসার জীবনের প্রধান কাজ। তেমনি, ঈসা মসীহের প্রধান কাজ ছিল আল্লাহর বান্দাদের জন্য নাজাতের ব্যবস্থা করা যেন তারা গুনাহের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে একটি রুহানিক সুখ-শান্তির দেশে (অর্থাৎ বেহেশতে) যেতে পারে।

দ্বিতীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্য: একজন মধ্যস্থকারী

মূসা নবী আল্লাহ ও তার লোকদের (বনি ইসরাইল) মধ্যে একজন অনন্য মধ্যস্থতাকারী ছিলেন, যিনি আল্লাহর গজবের হাত থেকে তার লোকদের বাঁচাবার জন্য প্রায়ই অনুরোধ ও মধ্যস্থতা করতেন (শুমারী ২১:৭, ১৬:৪২-৫০, হিজরত ১৫:২৩-২৫, হিজরত ১৯)।

হযরত ঈসার আগে যত নবী এসেছিলেন, কারোরই এই মধ্যস্থতার পদ ছিল না, কিন্তু ঈসা মসীহের প্রধান ভূমিকা ছিল আল্লাহ্‌র বান্দাদের হয়ে আল্লাহর কাছে মধ্যস্থতা করা (১ তিমথীয় ২:৫, ইবরানী ৭:২৫)।

তৃতীয় বিশেষ বৈশিষ্ট্য: একটি নতুন চুক্তি

মূসা বনি ইসরাইলদের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থা এনেছিলেন- মূসা ও ঈসা নবীই হলেন দুইজন নবী যারা আল্লাহ আর মানুষের মধ্যে নতুন ব্যবস্থা বা চুক্তি স্থাপন করেছেন। ঈসা নবীর দেওয়া এই নতুন ব্যবস্থার বিষয়ে নবী ইয়ারমিয়া বলেছেন:

“মাবুদ বলছেন, “সময় আসছে যখন আমি ইসরাইল ও এহুদার লোকদের জন্য একটা নতুন ব্যবস্থা স্থাপন করব। মিসর দেশ থেকে তাদের পূর্বপুরুষদের আমি হাত ধরে বের করে আনবার সময় তাদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলাম এই নতুন ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থার মত হবে না। আমি যদিও তাদের স্বামীর মত ছিলাম তবুও তারা আমার ব্যবস্থা ভেংগেছিল। পরে আমি বনি-ইসরাইলদের জন্য যে ব্যবস্থা স্থাপন করব তা হল, আমার শরীয়ত আমি তাদের মনের মধ্যে রাখব এবং তাদের দিলেও তা লিখে রাখব। আমি তাদের আল্লাহ্ হব আর তারা আমারই বান্দা হবে।” (ইয়ারমিয়া ৩১:৩১-৩৩)

ঈসা মসীহের “নতুন ব্যবস্থা” (লূক ২২:২০)-এর অংশ হিসেবে তিনি অধিকারের সহিত একটি অন্তর্মুখী শরিয়তের শিক্ষা দিতেন (মথি ৫-৭)। মুহাম্মদ (সা) কখনোই দাবি করেন নি যে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে কোন নতুন ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন, বরং তিনি ইবরাহিমের সময়কার সেই একই ব্যবস্থা আরবীয়দের মাঝে পুনর্বহাল করতে চেয়েছিলেন।

আসলে, হযরত মূসার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি তা তৌরাত এবং কোর’আন শরীফে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত আছে:

আজ পর্যন্ত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে মূসার মত আর কোন নবীর জন্ম হয় নি যাঁর কাছে মাবুদ বন্ধুর মত সামনাসামনি কথা বলতেন। মাবুদ মূসাকে মিসর দেশে ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারী এবং তাঁর গোটা দেশের উপর যে সব অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখাবার জন্য পাঠিয়েছিলেন সেই রকম কাজ আর কেউ করে নি।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:১০-১১)

“তোমাদের মধ্যে কোন নবী থাকলে আমি মাবুদ দর্শনের মধ্য দিয়ে নিজেকে তার কাছে প্রকাশ করি আর কথা বলি স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আমার গোলাম মূসার সংগে আমি তা করি না …আমি তার সংগে সামনাসামনি পরিষ্কার ভাবে কথা বলি, কোন ধাঁধার ভিতর দিয়ে নয়।” (শুমারী ১২:৬-৮)

“মানুষ যেমন মুখোমুখি হয়ে বন্ধুর সংগে কথা বলে মাবুদ ঠিক তেমনি করেই মূসার সংগে কথা বলতেন।” (হিজরত ৩৩:১১)

এই আয়াত থেকে আমরা আমাদের তালিকায় হযরত মূসার আরো দু’টি “বিশেষ বৈশিষ্ট্য” যোগ করতে পারি:

চতুর্থ বিশেষ বৈশিষ্ট্য: দর্শন ও ফেরেস্তাদের সাহায্য ছাড়া সরাসরি আল্লাহর কথা শুনতেন

হযরত মূসা দর্শন বা ফেরেশতাদের সাহায্য ছাড়া সরাসরি আল্লাহ্‌র সঙ্গে কথা বলতেন (শুমারী ১২:৬-৮, হিজরত ৩৩:১১)। কোরআনেও লেখা আছে যে

“আর আল্লাহ মূসার সাথে কথোপকথন করেছেন সরাসরি (تَكلِيمَا)।” (সুরা নিসা ৪:১৬৪)।

সূরা বাকারা ৯৭ আয়াতের বর্ণনা অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ (সা) একজন ফেরেশতার মারফতে ওহী পেয়েছিল। ইঞ্জিলের বর্ণনা অনুযায়ী ঈসা মসীহ্‌ মূসার মত করে সরাসরি আল্লাহ্‌র সংঙ্গে কথা বলতেন। ইঞ্জিল শরীফের মথির ১৭, মার্কের ৯ এবং লূকের ৯ অধ্যায়ে বর্ণিত ঘটনায় আমরা দেখি যে পাহাড়ের উপর যখন ঈসা নবীর চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠে তখন আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলতেন, ঠিক যেমনটি তিনি মূসা নবীর সাথে বলতেন। ইঞ্জিল শরীফে এটি পরিষ্কার ভাবেই বলা আছে যে ঈসা নবী কোন ফেরেস্তার মধ্যস্ততা ছাড়াই আল্লাহর কথা শুনতেন।

পঞ্চম বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
অনেক চিহ্ন, কেরামতী ও অলৌকিক কাজ দেখানো

কোরআন শরীফ অনুযায়ী, ঈসা মসীহ্‌ অনেক আশ্চর্য কেরামতী কাজ করেছেন (৩:৪৯, ২:২৫৩), কিন্ত কোরআন শরীফ অনুযায়ী, হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) একমাত্র নিদর্শন ছিল কোরআন শরীফই (২৯:৪৮-৫১), অর্থাৎ তিনি অন্য তেমন কোনো অলৌকিক কাজ করেননি। তৌরাত শরীফ এবং ইঞ্জিল শরীফে হযরত মূসা এবং ঈসার অনেক কেরামতী কাজের বর্ণনা আছে।

মূসা এবং ঈসার অন্যান্য সাদৃশ্য

আমরা যদি মূসা ও ঈসা নবীর মধ্যে কিছু সাধারণ বাহ্যিক মিলও খুঁজতে চাই তাহলে ডঃ নায়েক ও দিদাতের প্রস্তাবিত মুহাম্মদ ও মূসা মধ্যেকার মিলের চেয়ে আরও দ্বিগুণ মিল আমরা মূসা ও ঈসার নবীর মধ্যে দেখতে পাবো:

৬. মূসা ও ঈসা নবী দুজনেই ইসরাইল-বংশোভুত ছিলেন, কিন্তু মুহাম্মদ বনি-ইসরাইলের লোক ছিলেন না।৭. মূসা ও ঈসা দুজনেরই জন্ম গরীব অপ্রভাবশালী পরিবারে হয়েছিল, কিন্তু হযরত মুহাম্মদ জন্ম মক্কার একটি প্রভাবশালী পরিবারে হয়েছে।৮. হযরত ঈসা ও মূসা দু’জনেরই প্রতিপালন করেছে তাদের আপন মা, কিন্তু হযরত মুহাম্মদকে প্রতিপালন করেছে তার বেদুইন ধাত্রী হালিমাহ্‌।

৯. জন্মের পরপরই মূসা ও ঈসা নবীকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল নিজ দেশের শাসনকর্তার হুকুমে।

১০. জন্মের পরপরই মূসা ও ঈসা দুজনকেই ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছিল।

১১. হযরত মূসা ও ঈসা মসীহ্‌ দুজনই মিসর থেকে ফিলিস্তিন যাত্রা করেন।

১৩. মূসা ও ঈসা নবী দুজনেই আল্লাহর সাথে “সামনা-সামনি” একটা পাহাড়ের উপরে কথা বলেন (হিজরত ৩৩:১১, মথি ১৭:৩),যার পরে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে (হিজরত ৩৪:২৯, মথি ১৭:২)।

১৪. মূসা ও ঈসা দুজনেই পানির উপরে তাদের অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন; মূসা নবী লোহিত সাগরকে দুভাগ করেছেন এবং ঈসা নবী গালীল সাগরে ঝড় থামিয়েছিলেন।

১৫. মূসা ও ঈসা নবী দুজনই তাদের তবলীগ শুরু করার আগে একটি নির্জন মরু এলাকায় প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন; মূসা চল্লিশ বছর ধরে (হিজরত ৭:৭) এবং ঈসা চল্লিশ দিন ধরে (প্রেরিত ৭:২৩, মথি ৪:১)।

১৬. মূসা ও ঈসা নবী দুজনই ভবিষ্যদ্বানী করেছেন যা পরবর্তীতে পরিপূর্ণ হয়েছিল (দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫-২২; ২৮:১৫-২৯:৬৭; মথি ২৪)।

১৭. কিতাবগুলোতে দুজনকেই “বিশ্বস্ত সেবাকারী” বলা হয়েছে।

সমালোচকরা হয়ত বলবেন — যেহেতু দ্বিতীয় বিবরণের শেষে (৩৪:১০-১২) বলা হয়েছে যে মূসার মত আর কোন নবী ইসরাইলদের মধ্যে থেকে আসবে না সেহেতু সেই নবীকে অবশ্যই ইসরাইল বংশের বাইরের হতে হবে।

আসলে, এই আয়াত শুধুমাত্র বলছে যে তৌরাত নাজেলের শেষ পর্যন্ত (“আজ পর্যন্ত”), অর্থাৎ ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আগে, মূসার মত আর কোন নবী আসেনি। যদি অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের কথা এখানে বোঝানো হত তাহলে “আজ পর্যন্ত” কথাটি থাকত না, বরং শুধু লেখা থাকত “বনি-ইসরাইলদের মধ্যে মূসার মত আর কোন নবীর জন্ম নিবে না।”

আসলে, এই অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে যে মূসার কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো ঈসা মসীহের জীবনে ছিল, যেভাবে আগের পৃষ্ঠায় বোঝানো হল—তিনি আল্লাহ্‌র সংঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন এবং অনেক কেরামতী কাজ দেখিয়েছেন:

আজ পর্যন্ত বনি-ইসরাইলদের মধ্যে মূসার মত আর কোন নবীর জন্ম হয় নি যাঁর কাছে মাবুদ বন্ধুর মত সামনাসামনি কথা বলতেন। মাবুদ মূসাকে মিসর দেশে ফেরাউন ও তাঁর কর্মচারী এবং তাঁর গোটা দেশের উপর যে সব অলৌকিক চিহ্ন ও কুদরতি দেখাবার জন্য পাঠিয়েছিলেন সেই রকম কাজ আর কেউ করে নি।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:১০-১১)

আল্লাহ্‌র কালামে কি বলা আছে?

আল্লাহ্‌র কালাম পবিত্র ইঞ্জিল শরীফে সুনির্দিষ্ট ভাবে লেখা আছে যে দ্বিতীয় বিবরণ ১৮-এর ভবিষ্যদ্বানী ঈসা মসীহে পূর্ণতা পেয়েছে:

ঈসার সাহাবী পিতর সাক্ষ্য দিয়েছেন: “আমাদের পূর্বপুরুষদের আল্লাহ্ এই কাজের দ্বারা নিজের গোলাম ঈসার মহিমা প্রকাশ করেছেন…তা অনেক দিন আগেই পবিত্র নবীদের মধ্য দিয়ে বলেছিলেন… নবী মূসা বলেছিলেন, ‘তোমাদের মাবুদ আল্লাহ্ তোমাদের ভাইদের মধ্য থেকেই তোমাদের জন্য আমার মত একজন নবী দাঁড় করাবেন…এছাড়া নবী শামুয়েল থেকে শুরু করে যে সব নবীরা কোন কিছু বলে গেছেন তাঁরাও এই সময়ের কথা আগেই বলে গেছেন” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৪:১০-১১, দেখুন ইবরানী ৩:১-৩)

ঈসা মসীহ্‌ নিজেই বলেছেন: “যদি আপনারা মূসাকে বিশ্বাস করতেন তবে আমাকেও বিশ্বাস করতেন, কারণ মূসা নবী তো আমারই বিষয়ে লিখেছেন।” (ইউহোন্না ৫:৪৬)

 

ইঞ্জিলে দ্বিতীয় বিবরণ ১৮-এর ভবিষ্যদ্বানী উদ্ধৃতি করে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে ঈসা মসীহেরই কথা সেখানে বলা হয়েছে, কিন্তু কোর’আন শরীফে শুধুমাত্র অস্পষ্টভাবে লেখা আছে যে পূর্ববর্তী কিতাবের কোন এক জায়গায় একজন নিরক্ষর নবীর কথা বলা আছে। ইঞ্জিলে যেভাবে সুনির্দিষ্টভাবে লেখা আছে যে দ্বিতীয় বিবরণ ১৮-এ ঈসা মসীহের কথা বলা হয়েছে সেইভাবে কোর’আনে কোথাও এইরকম সুস্পষ্টভাবে লেখা নেই যে দ্বিতীয় বিবরণে মুহাম্মদেরই (সা) বিষয়ে বলা হয়েছে।

* * *

  1. হামিদুল্লাহ্‌র ফরাসি কোর’আন অনুবাদ থেকে, সূরা আল-আ’রাফ ৭৬৫,৭৪-এর টিকা Le Coran, Le Club Français du Livre, 1959.
  2. বি,বি,এস অনূদিত কিতাবুল মোকাদ্দসে এখানে אח বোঝানোর জন্য অনুবাদ হয়েছে “ইসরাইলীয় ভাই”, কিন্তু মূল হিব্রু ভাষায় “ইসরাইলীয়” শব্দটা নাই

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *