জাকির নায়েকের যুক্তি কি নির্ভরযোগ্য?

দারুল উলুম দেওবন্দের দারুল ইফতা (ভারতবর্ষের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী মাদ্রাসা) জাকির আব্দুল কারিম নায়েকের বিরুদ্ধে একটি আনুষ্ঠানিক ফতোয়া দিয়েছেন। ২০০৮ সালে এরা নায়েকের সম্বন্ধে বলেছেন—

“…একজন গাইর মুক্বাল্লিদীন প্রচারক …তার কথার উপর নির্ভর করা উচিত নয়”

“…তিনি নির্ভরযোগ্য নন, এবং মুসলমানদের তার কথা শোনা উচিত নয়।”

এরা আরো বলেন যে—

“…ভুল ধারণা ছড়িয়ে তিনি ইলম ও হিকমতের পথ থেকে সরে গেছেন এবং সরল মুসলমানদের ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাচ্ছেন।”

আরো অনেক বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও ধর্মীয় নেতা জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে এই ধরনের বিরোধিতা প্রকাশ করেছেন। জুন ২০১০ সালে জাকির নায়েকের যুক্তরাজ্যে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা সমর্থন করেছে যুক্তরাজ্যের ২০লক্ষ সুন্নি মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব British Muslim Forum সংগঠন। মাওলানা আহমাদ নিসার বেগ কাদরি, ব্রিটিশ মুসলিম ফোরামের ভাইস-চেয়ারমান বলেন—

“Dr. Zakir Naik is a very controversial figure. He openly supports Al Qaeda and the Talibans. He openly ridicules other faiths as well as the beliefs of the Ahl-us-Sunna (Traditional Sunnis)… Dr Zakir Naik is medical doctor by professional training and not an Islamic preacher or scholar. He has no degree in Islamic studies and gives speeches designed to mock and incite hatred of other faiths as well as create divisions amongst Muslim sects. Those Muslims who support Naik are in the minority. They are either Wahhabi-influenced or, English-speaking Muslim enthusiasts wanting, with the right intentions, to learn about their religion but from the wrong guy”[ ডাঃ জাকির নায়েক বেশ বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। তিনি প্রকাশ্যে আল-কায়েদা ও তালেবানদের সমর্থন করেন। তিনি প্রকাশ্যে অন্যান্য ধর্ম এবং আহ্‌ল-উস-সুন্না সম্পর্কে টিটকারি করেন … ডাঃ জাকির নায়েক পেশা হিসেবে একজন ডাক্তার, ইসলামী প্রচারক বা পণ্ডিত নন। ইসলামি স্টাডিসে তার কোনো ডিগ্রী নেই। অন্য ধর্মকে ব্যঙ্গ করা ও এদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তিনি বক্তৃতা দেন, তা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন মুসলমান দলের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করেন। যারা নায়েকের সমর্থন করেন তারা সংখ্যালঘু। এরা হয় ওয়াহাবী-প্রভাবিত মুসলমান আর হয় ইংরেজি-ভাষী মুসলমান যারা ভাল উদ্দেশ্যে ভুল ব্যক্তির কাছে ধর্মের দীক্ষা পাচ্ছে।]

নায়েকের বিরুদ্ধে আরো বলেছেন লখনউ শহরের কাজী মাওলানা মুফতি আব্দুল ইরফান কাদভী, উত্তর প্রদেশের মুফতি মুহাম্মদ আশরাফ কাদভী, এবং মাওলানা আশরাফ রাজা।

টেলিভিশনের এই “শান্তি”প্রচারক ডাঃ জাকির নায়েকের উপর সুশিক্ষিত মুসলমানরা এত অসন্তুষ্ট কেন? এই প্রবন্ধে আমরা এর বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করে দেখব।

নায়েকের অনর্গল ইংরেজি, আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গি, এবং অন্যান্য ধর্মের অপব্যাখ্যা, ব্যঙ্গ ও তামাশা করার দক্ষতা দিয়ে তাঁর ভক্তদের কাছে এই টেলিভিশন বক্তা একজন বিনোদনধর্মী প্রচারক হিসেবে রক্‌-স্টারের মত আভা লাভ করেছেন। কিন্তু অন্যদের কাছে তিনি শুধু একজন দক্ষ বক্তা ও মেমরী ড্রাইভ্‌; তার যুক্তি দুর্বল, তিনি প্রায়ই ভুল তথ্য দেন, এবং তার চরমপন্থী মতবাদ বিপদজনক। জাকির নায়েকের মিথ্যা পরিসংখ্যান প্রসঙ্গবহির্ভূত অসত্য-উদ্ধৃতি এবং সুচিন্তিত ভুলব্যাখার জন্য টেলিভিশন মাধ্যম অতুলনীয়। এই পুস্তিকাটিতে আমরা রূপকভাবে “টেলিভিশন রিমোট কন্ট্রোলের পজ বাটন” টিপে জাকির নায়েকের যুক্তি ও তথ্যগুলো ভালভাবে বিশ্লেষণ করব।

কিন্তু নায়েকের যুক্তির দুর্বলতা দেখার আগে তার বিভিন্ন ভাল দিকও উল্লেখ করা উচিত। তিনি তার শ্রোতাদের কোর’আন শরীফ মাতৃভাষায় পড়তে উৎসাহিত করেন, যেটা সমাজে আজকাল খুব দরকার। টাকা-পয়সা অথবা বলিউড তারকাদের পিছনে না ছুটে তিনি যুব-সমাজদের আল্লাহ্‌র খোঁজ করতে উৎসাহিত করেন। তিনি মদ-খাওয়া, অশালীনতা, ব্যভিচার, এবং কৃপণতার বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই সবই প্রশংসার যোগ্য।


সূচিপত্র:

জাকির নায়েক কি ইসলামের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করেন?
জাকির নায়েক ও ইসলামী চিন্তা
বিজ্ঞান নিয়ে..
তুলনামূলক ধর্ম নিয়ে
জাকির নায়েক ও সন্ত্রাসবাদ

নায়েকের বিভিন্ন কায়দা-কৌশল
বিবর্তনবাদ নিয়ে জাকির নায়েক— ৫ মিনিটে ২৫টি মিথ্যা
পুরোপুরি ভুল তথ্য
নারী-পুরুষ অনুপাতের পরিসংখ্যান
পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম, পিপীলিকার মধ্যে নেতা?
ব্যাপক ধর্মান্তর
মিথ্যা গুজব ছড়ানো
ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে শ্রোতাদের অজ্ঞতা ব্যবহার করা
দ্রুতবেগে অর্ধসত্য বলা
শ্রোতাদেরকুসংস্কারের ফায়দা লুট
কম্পিউটারের মত স্মরণশক্তি
পশ্চিমা সম্পর্কে অজ্ঞতা
পশ্চিমা কি ইসলাম গ্রহণ করছে?
আমেরিকাতে খয়রাতি দান
আমেরিকাতে সমকামিতার হার
পশ্চিমাতে ঘুষ ও দুর্নীতি
হিজাব ও নারী-নির্যাতন
বাছাই করা বুদ্ধিজীবীর উদ্ধৃতি
ধর্মগ্রন্থের প্রসঙ্গবহির্ভূত উদ্ধৃতি
মনগড়া শব্দার্থ
ভুলভাবে কিতাব উপস্থাপনা
অসম নীতি
টেলিভিশন যোগাযোগমাধ্যম
বিতর্কে সত্যিই অপরাজিত?


 

জাকির নায়েক কি ইসলামের
যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করেন?

মুসলমানদের সম্পর্কে বিশ্বের যে খারাপ ধারণা রয়েছে, যে তারা গোঁড়ামিপূর্ণ, উদ্ধত এবং অসৎ, তা জাকির নায়েক বিশ্বের কাছে কেবলই সমর্থন করেন। মুসলমান এবং অমুসলমান দু’জনেরই জানা দরকার, যে তিনি মধ্যপন্থী ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করেন না। নায়েকের বিশেষ মতামতকে বলা হয় ‘ওয়াহাবীবাদ’, যা হচ্ছে ইসলামে বেশ নতুন একটি ধারা। গত কয়েক দশকে কোটি কোটি পেট্রো-ডলার দিয়ে সৌদিরা এই কট্টরপন্থী মতবাদকে মুসলমান জগতে ছড়িয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে জাকির নায়েকের মত লোকের মধ্য দিয়ে।

অনেক সুশিক্ষিত মুসলমানদের দৃষ্টিতে, ওয়াহাবি মতবাদ হল মুসলমান সমাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাইরাস বা ক্যান্সার। অল-ইন্ডিয়া উলেমা কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা মেহমুদ দরিয়াবাদী নায়েকের সম্পর্কে বলেছেন—

“…তিনি কোন ‘আলেমও নন, কোন মুফতিও নন। তিনি যেভাবে ইচ্ছা ইসলাম অনুশীলন করতে পারেন, কিন্তু মঞ্চ থেকে তার ফাতোয়া দেয়া উচিত না।”

সমাজবিজ্ঞানী ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন,

সৌদিরা মনে করেন যে সারাবিশ্বের মুসলমানদের শুদ্ধিবাদী সালাফি ইসলামে কন্‌ভার্ট করতে তাদের আল্লাহপ্রদত্ত অধিকার আছে। নায়েক হল জনগণের কাছে তাদের চেহারা… এই অহংকারী ওয়াহাবি মতবাদ ইন্ডিয়ার প্রচলিত সহনশীল ইসলামের বিপরীত। আমি তাকে টেলিভিশনে কয়েক বার দেখেছি এবং আমি তার বিষয়ে গভীরভাবে হতাশ।

নায়েক অবশ্যই ওয়াহাবি বা সালাফি হওয়ার অস্বীকার করবে (অধিকাংশ ওয়াহাবিরা যেমন করে), কিন্তু তার মতামতগুলো প্রকাশ্য ওয়াহাবি। ওয়াহাবি মতবাদ হচ্ছে কঠোরভাবে আক্ষরিক এবং মৌলবাদী এক সৌদি রপ্তানি, এবং তা অধিকাংশ ভারতবর্ষের মুসলমান ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপক্ষে। জাকির নায়েকের কয়েক বিশেষ ওয়াহাবী ধারণা নিম্নে দেওয়া আছে, যেগুলো অধিকাংশ ভারতীয় মুসলমানদের ধারণার বিপরীত—

ইসলামী শরিয়ত এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পর্কে— নায়েক দাবি করেন যে, “ভারতের মুসলমানরা চায় যেন ইসলামী আইন (শরিয়ত) ভারতের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর জারি হয় কারণ সেটা সবচেয়ে সহজ।”

সুফি অলি আউলিয়াদের সম্মান করা— যেসব মুসলমানগণ সুফি অলি-আউলিয়াদের সম্মান করে ও মাজারে যায়, নায়েক তাদেরকে বলেন “কবর পূজাকারী”

অন্য ধর্ম সম্পর্কে— ২০০৩ সালে টরন্টো শহরে নায়েক এক বক্তৃতায় বলেন মুসলমানদের কাছে খ্রীষ্টান বন্ধুদের “শুভ বড়দিন” বলা হারাম।

 

পেট্রোডলার দিয়ে সৌদি আরব তাদের গোড়া ওয়াহাবী দৃষ্টিভঙ্গি ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা মুসলিম জগতে। কিছু শিক্ষিত মুসলিম নেতা হতাশা প্রকাশ করেছেন যে মননশীল ইসলামী ধারণা প্রচার করতে কোন পেট্রোডলার দেওয়া হয় নাই।

২০০৮ সালে ইন্ডিয়ার সর্বোচ্চ সুন্নি ইসলামী সংস্থা, রাজা একাডেমি, জাকির নায়েকের টেলিভিশন প্রোগ্রাম বন্ধ করার দাবী করেছেন। দারুল-উলুম হানাফিয়া রিজবিয় (মুম্বাই)-এর মাওলানা আশরাফ রাজা নায়েকের বিরুদ্ধে আবার ফতোয়া দিয়েছেন। রাজা একাডেমির সদস্য ইবরাহিম তাহিল বলেন—

“তিনি আগে খ্রীষ্টানদের আক্রমন করতেন, কিন্তু এখন তিনি সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধে। আমরা আর.আর. পাতিল ও কেএল প্রসাদের সঙ্গে বৈঠক করে নায়েকের প্রোগ্রাম নিষেধ করতে তাদের উৎসাহিত করেছি।”

কিছু বিশিষ্ট ভারতীয় মুসলিম চিন্তাবিদ, যেমন সালমান খুরশিদ ও জাভেদ আখতার নায়েকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে তিনি ভারতীয় মুসলিম সমাজকে চরমপন্ঠী বানাতে চেষ্টা করছেন এবং জাতির মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করছেন। ভারতীয় মুসলমান নায়েকের বিরুদ্ধে রাগ প্রকাশ করেছেন যে তিনি সুফিদেরকে “কবর পূজাকারী” বলেন।

ইংল্যান্ডের কিছু মুসলমান জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে প্রচার করে দেখিয়েছেন যে তিনি ইসলামী ইতিহাস ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং তার গোড়া ওয়াহাবী দৃষ্টিভঙ্গি বিপজ্জনক।

জাকির নায়েকের দৃষ্টিতে, ইসলামি ইতিহাসের মধ্যে যা কিছুই আছে কেন তা অবশ্যই ত্রুটিহীন, এবং ইসলামি ইতিহাসের বাইরে যা কিছু আছে অবশ্যই ত্রুটিপূর্ণ ও খারাপ। তার দৃষ্টিতে, তার নিজের মতামতের বাইরে যা কিছু আছে সবই তার কাছে জাহিলিয়া (অজ্ঞতা), এবং ইসলামী উম্মাহ্‌র মধ্যে যা কিছু আছে তা বিশুদ্ধ। এই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে যখন নায়েক অখ্যাতিজনক বিশ্বাসঘাতক ইয়াযিদের সম্পর্কে বলেছেন “রাদি আল্লাহুতা’আলা আনহু”, অর্থাৎ “আল্লাহ্‌ তার উপর সন্তুষ্ট হউক।” এই ইয়াযিদ ছিলেন প্রাচীন ইসলামের একজন কলঙ্কিত নেতা, যাকে সুন্নি উলেমা বলেছেন “একজন ফাসিক (অপরাধী) যিনি নিজ মা, বোন ও মেয়ের সাথে যৌনসংগম করেছেন, যিনি মদ খেতেন ও নামাজ পড়েননি।”১০ মদিনার বিরুদ্ধে এক আক্রমনে তিনি ১,০০০ নারীর ধর্ষণ ও ১০,০০০ মানুষের বন্দীত্বে নেতৃত্ব দেন,১১ এবং বলা হয়েছে এই ইয়াযিদ সমকামী ছিলেন। কিন্তু জাকির নায়েকের দৃষ্টিতে, এই ইয়াযিদ হল একজন জান্নাতি মু’মিন যাকে সমর্থন করা দরকার।

নায়েকের মতবাদ হল এই ওয়াহাবি, মৌলবাদী, সঙ্কীর্ণচিত্ত মনোভাব, যার কাছে আত্মসমালোচনা অসম্ভব। এই মনোভাবের কারণেই ইসলামের স্বর্ণ যুগ শেষ হয়েছে। ইসলামি সাহিত্য এবং বৈজ্ঞানিক সাফল্য নিয়ে গর্ব করার মত অনেক কিছু আছে; কিন্তু ইসলামের স্বর্ণযুগ তখন হল, যখন ইসলামের তৎকালীন মনোভাব অন্য সভ্যতার প্রতি( যেমন গ্রিক ও হিন্দু সভ্যতার প্রতি) সবচেয়ে উদারপন্থী ছিল। সেই সময়ে ইসলামি শিক্ষার্থীগণ প্রায়ই অন্যান্য সভ্যতার সাহিত্য পাঠ করতেন এবং তাদের দর্শন প্রয়োগ করতেন। ইসলামি ইতিহাসের সেরা ব্যক্তিগণ, যেমন ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ, তারা অন্যান্য “জাহিলিয়া” সভ্যতার সাহিত্য ও চিন্তার প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন, যে তৎকালীন হুজুররা তাদের বিরোধিতা করতেন। এই ইসলামি পুনর্জাগরণের পতন ঘটল যখন জাকির নায়েকের মত সংকীর্ণচিত্ত প্রতিমূর্তি “অ-ইসলামি” গ্রীক ও হিন্দুদের সব জ্ঞান “জাহিলিয়া” (অজ্ঞতা) ও প্রলোভন বলে নিষেধ করলেন, এবং দাবি করলেন যেন ছাত্র-ছাত্রীরা শুধুমাত্র “খাঁটি ইসলামি” বিষয় পড়েন।১২ জাকির নায়েক সবচেয়ে জোর গলায় ইসলামি স্বর্ণ যুগ নিয়ে গর্ব করেন, কিন্তু তারই কট্টর মনোভাবের কারণে স্বর্ণযুগের পতন হয়েছে।

 

জাকির নায়েক ও ইসলামী চিন্তা

জাকির নায়েক একজন মেডিকেল ডাক্তার (শল্যবিদ) যার অসাধারণ স্মরণশক্তি ও বক্তৃতা দেওয়ার গুণ আছে, কিন্তু তিনি কোন ইসলামি পণ্ডিত নন। যিনি বিশেষ কিছু কিছু আয়াত ও উদ্ধৃতি মুখস্থ করেছেন, কিন্তু তিনি কোন পণ্ডিত বা চিন্তাবিদ নয়। ইসলামি ইতিহাস ও ইলমে তিনি বেশী আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি। যারা ইসলামের সেরা ধর্মতত্ত্ববিদ ও বৈজ্ঞানিক, তারা জাকির নায়েকের মতবাদ ও শিক্ষাকে তুচ্ছ করেন।

 

বিজ্ঞান নিয়ে

যেমন ধরেন, জাকির নায়েক টেলিভিশনে প্রায়ই কোর’আন শরীফকে “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়” বলে থাকেন, যে ধারণাকে বলা হয় “বুকাইলিবাদ”। কোরআন শরীফে দুর্বোধ্য বিজ্ঞানের বিস্ময় চিহ্নিত করা ইসলামী ইতিহাসে খুব অল্পদিনের একটি ধারা। ফান্ডামেলটালিস্টদের মধ্যে বুকাইলিবাদ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে, কিন্তু মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তেমন সমর্থন পায় নি। ভারতের সুপরিচিত ইসলামিক ধর্মতত্ত্ববিদ ও বেহেশ্‌তী জেওর -এর রচয়িতা, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) চারটি কারণে বুকাইলিবাদ পন্থার বিরোধিতা করেন।১৩ একইভাবে, পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান মুসলিম বিজ্ঞানীরা বুকাইলিবাদ প্রচেষ্টা দেখে শুধু লজ্জিত হন। লন্ডনের বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ জিয়াউদ্দিন সরকার , তার বই Explorations in Islamic Science এই ‘বৈজ্ঞানিক বিস্ময়’ যুক্তিকে বলেন “apologia of the worst type” (আত্মপক্ষসমর্থনের সবচেয়ে নিম্ন প্রকার)। Penn State বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ইতিহাসলেখক নোমানুল হক হলেন একজন বিশিষ্ট বুকাইলিবাদ সমালোচক। তিনি বুলাইলিবাদের বৃদ্ধির মূল কারণকে আরোপ করেন ঔপনিবেশিকতাবাদে লজ্জিত এবং ইসলামি বিজ্ঞানের হারানো গৌরব আবার অধিকার করতে ইচ্ছুক মসলমানদের মধ্যে “একটি গভীর হীনমন্যতাবোধ।”১৪ আরেকজন মুসলিম বুকাইলিবাদের সমালোচক হল মুজাফফর ইকবাল , যিনি কানাডার অ্যালবার্টায় অবস্থিত Center for Islam and Science সংস্থার প্রেসিডেন্ট।

পাকিস্তানের বিশিষ্ট পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানী পারভেজ হুদভয় বলেছেন—

the problem with such claims to ownership is that they lack an explanation for why quantum mechanics, molecular genetics, etc., had to await discovery elsewhere. Nor is any kind of testable prediction ever made. No reason is offered as to why antibiotics, aspirin, steam engines, electricity, aircraft, or computers were not first invented by Muslims. But even to ask such questions is considered offensive.১৫

 

[এই রকম মালিকানার দাবির সমস্যা হল কেন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান, মলিকিউলার জেনেটিক্স, ইত্যাদি অন্য জায়গা আবিষ্কারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারে না। । আর বিভিন্ন গবেষণা বা পরীক্ষা করে প্রমাণ করার মতো কোন বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বানী কোরআনে কখনো করাও হয় নি। কোরআনে যদি বৈজ্ঞানিক নানা ভবিষ্যদ্বানী থেকেই থাকে তাহলে কেনই বা সবার আগে মুসলমানরা এন্টিবায়োটিক, এসপিরিন, বাষ্প-ইঞ্জিন, বিদ্যুত, বিমান কম্পিউটার উদ্ভাবন করেন নি। কিন্তু এই ধরণের প্রশ্ন কেবল উঠলেই সেটা আক্রমণাত্মক বলে মনে করা হয়।]

তুরস্কের মুসলিম দার্শনিক ও পদার্থবিজ্ঞানী তানের এদিস বলেছেন—

“Quran-science is pathetic, but this is realized by many Muslims as well. It does not characterize Islam any more than the Institute for Creation Research typifies Christianity. Yet, even with that important qualification, the ridiculous extreme I described above can illustrate the ambiguous relation between modern science and orthodox Islam. While most believers are content to ignore the issue and declare full scientific compatibility for the Quran, some intellectuals take a cognitive relativist path, or insist that science be structured by Islam so as to comply with an Islamic view of nature. ১৬

 

[“‘কোরআন-বিজ্ঞান’ (বুকাইলিবাদ) বিষয়টি হাস্যকর, কিন্তু অনেক মুসলমানেরাও তা-ও জানেন। সেটা ইসলামকে বিশেষভাবে প্রতিনিধিত্ব করে না যেমনই ক্রিয়েশন রিসার্চ ইন্সটিটিউট খ্রীষ্টধর্মকে প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু সেই গুরুত্বপূর্ণ সীমিতকরণ দেওয়ার পরেও, আধুনিক বিজ্ঞান ও গোঁড়া ইসলামের অমিল বোঝা যায় উপরোক্ত হাস্যকর উদাহরণে। অধিকাংশ ঈমানদার আসল বিষয়টা অবহেলা করে কোরআনের জন্যে পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সুসংগতি ঘোষণা দিতে তৃপ্ত থাকে, কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী আপেক্ষিক জ্ঞ৷নাহরনের পথ অবলম্বন করে, অথবা বলে যে বিজ্ঞান ইসলাম অনুসারে নির্মিত হওয়া উচিত যেন ইসলামী দৃষ্টিভুঙ্গির সঙ্গে খাপ খায়।”]

ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রিধারী মুসলিম জনপ্রিয় বক্তা আবু আম্মার ইয়াসির ক্বারী তার An Introduction to the Sciences of the Quran গ্রন্থে বলেছেন—

In other words, there are not scientific allusions buried under every third verse in the Qur’aan, waiting to be unearthed by some over-zealous, highly-imaginative Muslim!১৭

[অন্য কথায়, কোরআনের প্রতি তিনটি আয়াত অন্তর অন্তর এমন কোন বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত লুকিয়ে নেই যা কোন অতি-কল্পনাপ্রবণ বা অতি-আগ্রহী মুসলমানের দ্বারা উন্মোচনের অপেক্ষায় আছে।]

“ইসলামী বিজ্ঞান” বিষয়ে পাকিস্তানী মুসলিম নোবেলপ্রাপ্ত পদার্থবিজ্ঞানী ডঃ আব্দুস সালাম লিখেছেন—

There is only one universal science; its problems and modalities are international and there is no such thing as Islamic science just as there is no Hindu science, nor Jewish science, no Confucian Science, nor Christian Science.১৮[কেবল একটি মাত্র সার্বজনীন বিজ্ঞান রয়েছে যার বৈজ্ঞানিক সমস্যা এবং পন্থাগুলো আন্তর্জাতিক ও সার্বজনীন। যেহেতু হিন্দু বিজ্ঞান, ইহুদী বিজ্ঞান, কনফুসিয়াস বিজ্ঞান ও খ্রীষ্টান বিজ্ঞান বলে কিছু নেই সেহেতু ইসলামিক বিজ্ঞান বলেও কিছু নেই।]

 

তুলনামূলক ধর্ম নিয়ে

জাকির নায়েকের ভক্তদের দৃষ্টিতে তিনি ইসলামের প্রধান প্রতিনিধি, কিন্তু সুশিক্ষিত ও অবগত মুসলমানগণ জাকির নায়েকের মত তৌরাত-বাইবেল অস্বীকার ও তুচ্ছ করেন না। সুলতান অফ ওমান প্রোফেসর অফ আরব ও ইসলামী স্টাডিস্‌ ডাঃ আব্দুল্লাহ সায়ীদ এইভাবে লেখেন—

Since the authorized scriptures of Jews and Christians remain very much today as they existed at the time of the Prophet, it is difficult to argue that the Qur’anic references to Tawrat and Injil were only to the “pure” Tawrat and Injil as existed at the time of Moses and Jesus, respectively. If the texts have remained more or less as they were in the seventh century CE, the reverence the Qur’an has shown them at the time should be retained even today. Many interpreters of the Qur’an, from Tabari to Razi to Ibn Taymiyya and even Qutb, appear to be inclined to share this view. The wholesale dismissive attitude held by many Muslims in the modern period towards the scriptures of Judaism and Christianity do not seem to have the support of either the Qur’an or the major figures of tafsir.১৯

[“যেহেতু ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের স্বীকৃত কিতাবগুলো আজকালও নবীজীর আমলের মত, তাই এই বলা কঠিন যে কোর’আন শরীফ শুধু মূসা ও ঈসার যুগের “খাঁটি” তৌরাত ও ইঞ্জিল নিয়ে বলছেন। যদি কিতাবগুলো কমবেশী সপ্তম সতাব্দীর মত হয়ে থাকে, তাহলে সেকালের মর্যাদা ও সম্মান আজও সেগুলোকে দেখানো উচিত। অনেক তাফসীরকারী, যেমন তাবারি থেকে রাজি থেকে ইবন তামিয়য়া এমনকি কুত্‌ব, এই মতামত সম্পর্থন করেন। তৌরাত ও ইঞ্জিলের প্রতি আজকাল অধিকাংশ মুসলমানদের অবহেলার মনোভাব কোরআন ও তাফসীরকারীদের লেখায় কোন সমর্থন পায় না।”]

 

জাকির নায়েক ও সন্ত্রাসবাদ

জাকির নায়েক একজন ওয়াহাবি মৌলবাদী হয়ে সন্ত্রাসবাদ অস্বীকার করতে অনিচ্ছুক। একসময়ে যখন তাকে তালেবান ও আল-কায়েদার হিংস্রতা অস্বীকার করতে চাপ দেওয়া হল, তখন তিনি তা করেন নি বরং বলেছিলেন,

 

“Beware of Muslims saying Osama Bin Laden is right or wrong. I reject them … we don’t know. But if you ask my view… I am for him. …if he is terrorising America the terrorist, the biggest terrorist, every Muslim should be a terrorist. The thing is, if he’s terrorising a terrorist, he’s following Islam” 

[ “যে মুসলমানরা ওসামা বিন লাদেনকে ঠিক বা বেঠিক বলেন তাদের হইতে সাবধান। আমি এদের অস্বীকার করি। আমরা জানি না…কিন্তু আমার মতামত জানতে চাইলে, আমি বলি যে আমি তার পক্ষে…তিনি যদি সে সন্ত্রাসী আমেরিকার (সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী) বিরুদ্ধে অত্যাচার করেন… তাহলে আমি তার পক্ষে… প্রত্যেক মুসলমানদের সন্ত্রাসী হওয়া উচিত। বিষয়টি হচ্ছে, তিনি যদি সত্রাসীদের উৎপীড়ন করেন, তাহলে সে ইসলাম অনুসরণ করছেন।” ]

সন্ত্রাসীদের বীর জাকির নায়েক

বিশেষ করে আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী এবং সন্ত্রাসীদের কাছে জাকির নায়েক খুব প্রিয়, দেখিয়েছেন ইংল্যান্ডের একজন মধ্যপন্থী মুসলমান। কাফিল আহমেদ , যিনি স্কটল্যান্ডের গ্ল্যাস্কো বিমানবন্দরে আত্মঘাটি বোমা হামলার চেষ্টা করেছিল, তিনি ক’য়েক মাস আগে জাকির নায়েককে তাঁর বাড়িতে লেকচার দেওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। যখন করাচির লাল মসজিদ থেকে তালেবান জঙ্গিদের বের করা হল, তখন The Dawn সংবাদপত্র অনুযায়ী, তাদের সরঞ্জামের মধ্যে বিশেষ করে জাকির নায়েকের অনেক বেশী ভিডিও পাওয়া গিয়েছিল।

 

নায়েকের বিভিন্ন কায়দা-কৌশল

নায়েক প্রপাগান্ডাতে একজন বিশেষজ্ঞ। তার PeaceTV টেলিভিশন চ্যানেলে তিনি নিজেকে একজন পাণ্ডিত্যের ভাব দেখায় কিন্তু তিনি আবার প্রায়ই অর্ধসত্য বলে, মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করেন, এবং ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি বিকৃত করেন। তাঁর প্রপাগান্ডার ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি প্রকৃত তর্কবিদদের সঙ্গে তর্ক করেন না (যেমন স্যাম শামাউন বা আলী সিনা), বরং শুধুমাত্র বয়স্ক বা দুর্বল বক্তাদের সঙ্গে তিনি তর্ক করেন। নিচে আমি নায়েকের কিছু প্রধান প্রপাগান্ডার কায়দা-কৌশলগুলো প্রকাশ করেছি, এবং প্রত্যেক বিষয়ে কয়েকটি বাস্তব উদাহরণ দিয়েছি।

পুরোপুরি ভুল তথ্য

নায়েকের অনেক তথ্য পুরোপুরি মিথ্যা। আসুন আমরা নায়েকের একটি ছোট বক্তৃতা দেখি, এবার বিবর্তনবাদ নিয়ে, যেটা Youtube-এও দেখা যায়—

 

বিবর্তনবাদ নিয়ে জাকির নায়েক—
পাঁচ মিনিটে ২৫টি মিথ্যা

(নায়েকের কথা) In “The Origin of Species” – It says that Charles Darwin went on an island by the name of Keletropist 1 on a ship named as HMS Beagle, and there he found birds pecking at niches2. Depending upon the ecological niches they peck, the beaks kept on becoming long and short. This observation was made in the same species, not in different species 3,4.

Charles Darwin wrote a letter to his friend, Thomas Thromtan, 5 in 1861 saying, “I do not believe in ‘natural selection,’ the word that you use, I don’t believe in “Theory of Evolution” because I haven’t got any proof. I only believe in it because it helps me in classification of embryology, in morphology, in rudimentary organs. Charles Darwin himself said that there were missing links, he did not agree with it, 6 he himself said that there were missing links…

…the reason is because that if you analyze the church, the church was against science previously. 7 And you know the incident that they sentenced Galileo to death; 8 they sentenced Galileo to death. 8 Why? Because he said certain statements in the astronomy, etc., which went against the Bible, so they sentenced him to death 8, for which the Pope apologized now. So when Charles Darwin came up with a theory which goes against the Bible, they didn’t, they didn’t want any sufficient proof; ‘an enemy of my enemy is my friend’, so all the scientists, most of them, they supported the theory 9 because it went against the Bible, not because it was true.

…All the stages— there were four 11 “homonites,” 10 Science tells us today that there were four 11 “homonites,” 10 . First is “Lucy” along with its guy [sic] Dosnopytichest, 12 which died about 3 and ½ million years (the Ice Age). 13 Then next came the Homo sapiens who died out about five hundred thousand years ago. 14 Then came the “Neanderthal Man,” 15 who dies a hundred to forty thousand years ago. 16 Then came the fourth stage, the “CroMagnon”; 17–there is no link at all between these stages. 18 According to P.P. Grasse in 1971, who held the Chair of Evolutionary Studies in Paris, in Sorbonne University, 18ক he said, “It is absurd. We cannot say who were our ancestors based on fossils.. 18খSir Albert Georgie, 19 who got the Nobel Prize for inventing the vitamin C, 20 he wrote the book, “The Crazy Ape and Man” against Darwin’s theory. 21 Again, Sir Fred Hoyle’s work, he wrote several works against Darwin’s Theory. 21ক If you know about Ruperts Albert– this person wrote a new theory of evolution against Darwin’s theory. 21খa It’s unthinkable, you cannot think that we are created from the apes. 22 If you know of Sir Frank Salosbury, (he was a biologist), he said, “It is illogical to believe in Darwin’s theory.” Sir Whitemeat, 23 he wrote a book against Darwin’s theory, he was also a biologist … An amoeba at the lower species level… amoeba can change to parameshia. 24 … according to Henses Crake who is an authority in this field, 25 he said, “It is unimaginable.”

এখন এক এক করে নায়েকের মিথ্যা/ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছি—

১. “Keletropist” নামে পৃথিবীতে কোন দ্বীপই নেই। বিখ্যাত “গালাপাগোস” দ্বীপগুলোতে গিয়ে ডারউইন সেই পাখিগুলো দেখেছেন।২. ডারউইনের এই পাখিগুলো কোন কক্ষে (niches)– ঠোকর দেয় না (peck); বরং এরা ভিন্ন ecological niches এ বাস করে, অর্থাৎ পাখিরা বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশে বাস করে। এই গল্পের সাথে নায়েকের অস্পষ্ট ধারণা রয়েছে।

৩. না, গালাপাগোস দ্বীপে ডারউইন ১৪টি আলাদা প্রজাতির ফিঞ্চ পাখির ঠোঁট পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, নায়েকের কথামতে শুধু এক প্রজাতির নয়। এক এক প্রজাতির মধ্যে কোন ঠোঁটের পার্থক্য নেই। যেকোন পাঠ্যপুস্তকে এই তথ্য খুঁজে দেখুন।

৪. ভিন্ন ফিঞ্চের মধ্যে শুধু ঠোঁটের দৈর্ঘ্য নয়, বরং প্রজাতিগুলোর মধ্যে ঠোঁটের দৈর্ঘ্য ছাড়াও আরও অনেক পার্থক্য ডারউইন পর্যবেক্ষণ করেছেন— রং, দেহের আকার, সঙ্গীর সাথে ব্যবহার, গান এবং খাদ্যাভ্যাস। এগুলো এতই পৃথক ছিল যে ডারউইন দ্বীপে থাকার সময় বুঝতেই পারেননি, এরা সবাই ফিঞ্চ পাখি।

৫. ডারউইনের সমস্ত চিঠি, ডায়রি ও রচনা সবই প্রকাশিত এমনকি ইন্টার্নেটে সার্চ করার মত সবই বিনামূল্যে দেখা যায়, এবং সেখানে Thomas Thromtan নামে কারো দলীল নেই। ডারউইন এই কথা বলতে পারেননি যে “আমি বিবর্তনবাদ তত্ত্বে বিশ্বাস করি না, কারণ আমার কোন প্রমান নেই,” কারণ এই তথাকথিত চিঠি লেখার দু’বছর আগে সেই তত্ত্ব প্রমান করতেই তিনি অরিজিন অফ স্পিসিস লেখেন! থমসন নামে একজন ছিলেন, কিন্তু ডারউইন কখনই থমসনকে চিঠি লেখেননি।

৬. ডারউইন স্বীকার করেছেন যে মিসিং লিংক ছিল, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি তার নিজ তত্ত্ব বিশ্বাস করেননি— এমনকি, তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে কোথায় এই মিসিং লিংকগুলো পাওয়া যাবে।

৭. খ্রীষ্টধর্মের চার্চ কখনও বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ছিল না। গ্যালিলিওর আমলে প্রায় প্রত্যেক বিখ্যাত ইউরোপীয় বৈজ্ঞানিক ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান ছিল—এমনকি গ্যালিলিও নিজেই একজন ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান ছিলেন। নিউটন, কপারনিকাস, কেপলার, বয়েল, লিনিয়াস, প্যাসকেল সবাই বাইবেলে গভীর বিশ্বাস করতেন।

৮. গ্যালিলিওকে চার্চ কখনই মৃত্যুদণ্ড দেয়নি। ১৬৩৩ সালের ২২শে জুন তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে তাকে শুধু গৃহবন্দী রাখা হয়। এরও অনেক পরে ১৬৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি তিনি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেন। গ্যালিলিও (একজন ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক) বিশ্বাস করতেন যে তার সূর্যকেন্দ্রিকতাবাদ তত্ত্ব বাইবেলে সমর্থিত, এবং এই বিষয়ে তিনি একটি বই লেখেন, যেখানে তিনি অগস্টীনের মত কিছু প্রথম চার্চ ফাদার মন্তব্য বা তাফসীর তার পক্ষে ব্যবহার করেন। নায়েক এই ভুল আরো দু’বার বলেছেন, কিন্তু আমরা সেটাকে মাত্র একটি ভুল হিসেবে ধরবো।

৯. আসলে, ডারউইনের সময়কালে অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তাঁর বিবর্তনবাদ তত্ত্ব গ্রহণ করেননি (অনেক বছর ধরে), এবং এই বিজ্ঞানীদের অধিকাংশই ধার্মিক ছিলেন এবং চার্চকে ভুলেও নিজেদের শত্রু মনে করতেন না। মূল কথা, নায়েকের এই পুরা বর্ণনা মনগড়া মাত্র।

১০. এখানে ডাঃ নায়েকের প্রায় সব কথাই ভুল। হোমোনাইট বা হোমোনাইড বলে কিছু নেই। প্রকৃত শব্দটি হবে হোমিনিড (hominids)।

১১. শুধু চারটি হোমিনিড্‌ নয়, কমপক্ষে ১৪টি ধরনের হোমিনিড্‌ আছে।

১২. “dosnopytchest.” বলে কোন হোমিনিড্‌ নেই। লুসি যে হোমিনিডের অন্তর্ভুক্ত তার নাম Australopithecus afarensis.

১৩. Ice Age তথা বরফ যুগ মোটেই সাড়ে তিন মিলিয়ন বছর আগের ঘটনা না। ১.৬ মিলিয়ন বছর পূর্ব থেকে শুরু করে এই ১০ হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত বরফ যুগ ছিল।

১৪. হোমো স্যাপিয়েন্স নাকি ৫০০ হাজার বছর আগে মারা গেছে। বিবর্তনবাদ মানুক বা না মানুক, হোমো স্যাপিয়েন্স তো আমরা, যদিও “বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞ” ডাঃ জাকির নায়েক তার নিজের সম্পর্কেই জানেন না।

১৫. বিবর্তনবাদ তত্ত্ব মতে, নিয়ানডার্থালরা আধুনিক মানুষের পুর্বপুরুষ নয়, এরা বরফ যুগে অন্য শাখায় বিকশিত হয়েছে। নায়েক বলছেন নিয়ানডার্থালরা মানুষের উৎপত্তির একটি ধাপ, কিন্তু বিবর্তনবাদ অনুযায়ী এরা আমাদের পুর্বপুরুষ নয়।

১৬. নিয়ানডার্থালরা ৩০ হাজার বছর আগে লুপ্ত হয়েছিল, “একশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে” নয়।

১৭. ক্রো-ম্যাগনন আর হোমো স্যাপিয়েন একই কথা। ইউরোপিয়ান আপার প্যালিওলিথিক অঞ্চলের হোমো স্যাপিয়েন্সদেরকেই ক্রো-ম্যাগনন নামে ডাকা হতো।

১৮. হোমিনিডদের ধাপগুলোর মধ্যে অনেক লিংক আছে। শুধু Australopithecus afarensis এবং Homo sapiens এর মধ্যেই অন্তত তিনটি লিংক আছে— Homo habilis, Homo ergaster এবং Homo heidelbergensis.

১৮ক) P. P. Grasse-এর কথা বলতে গিয়েও নায়েক একটি ভুল করেছেন। প্যারিসে Sojerion University নামে কিছু নেই, সমগ্র বিশ্বের কোথাও এই নামের কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। তিনি বলতে চেয়েছিলেন “University of Paris” এর কথা যাকে মাঝে মাঝে “La Sorbonne” নামে ডাকা হয়। কিন্তু এটাকে আমরা ভুল হিসেবে ধরব না।

১৮খ) Pierre-Paul Grasse এই কথা বলেছিলেন ১৯৭১ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ৩৭ বছর আগে। সে সময় মিসিং লিংক হিসেবে পরিচিত জীবাশ্মগুলোর অধিকাংশই আবিষ্কৃত হয়নি। গত ৩৭ বছরেই প্রায় সব জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছে। সুতরাং গ্রাসে আজ থেকে ৩৭ বছর আগে কি বলেছিলেন তার আজ কোন মূল্যই নেই। ঠিক যেমন, এরিস্টটল আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে পরমাণু সম্পর্কে যা বলেছিলেন তার আজ কোন মূল্য নেই। সুতরাং এত আগের একটি উক্তি তুলে এনে জাকির নায়েক অসততার পরিচয় দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি আপাত অজ্ঞ মানুষদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। আরেকটি বিষয় বুঝতে হবে যে, গ্রাসে নিজেও বিবর্তন নিয়ে কোন সন্দেহ পোষণ করেননি। তিনি কেবল বলেছিলেন, সেটা প্রমাণের মত উপযুক্ত জীবাশ্ম আমাদের নেই। সেই জীবাশ্মগুলোই এর মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু আমরা এটাকে ভুল হিসেবে ধরব না।

১৯. Albert Georgie নামে কোন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী নেই। তিনি এখানে বোধহয় ভিটামিন সি আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী Albert Szent-Györgyi von Nagyrapolt-র কথা বলতে চেয়েছিলেন।

২০. গ্যোর্গি ভিটামিন সি উদ্ভাবন (invent) করেননি, তিনি সেটাকে আবিষ্কার (discover) করেছেন। ভিটামিন সি উদ্ভাবন (invent) করা সম্ভব না, কারণ এটা প্রকৃতিতেই পাওয়া যায়।

২১. Györgyi-র সেই বইয়ের নাম ‘The Cave Ape and Man’ নয় বরং “The Crazy Ape” (১৯৭০), এবং সেটা বিবর্তনবাদ তত্ত্বের কোন বৈজ্ঞানিক ভুলপ্রমান নয় বরং সমাজবিজ্ঞান নিয়ে একটি রচনা।২০

২১ক) ফ্রেড হয়েল ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী; জীববিজ্ঞানের উপর তার তেমন কোন দখল ছিল না। আর জ্যোতির্বিজ্ঞানেও তিনি যে মৌলিক অবদানটি রেখেছিলেন (Steady State Theory অর্থাৎ মহাবিশ্বের “স্থির অবস্থা তত্ত্ব”) তা বর্তমানে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এটাকেও আমরা একটি ভুল হিসেবে ধরব না।

২১খ) রুপার্টস আলবার্ট কে? এই নামে কাউকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। একজন লোক যে কি-না বিবর্তনের সম্পূর্ণ নতুন একটি তত্ত্বেরই জন্ম দিয়েছেন তার কোন নিশানাই পাওয়া যাবে না? বিস্ময়কর বটে!! কিন্তু এটাকেও আমরা একটি ভুল হিসেবে ধরব না।

২২. বিবর্তনবাদ ঠিক হোক বা বেঠিক হোক, সেটা অবশ্যই কল্পনা করা সম্ভব (thinkable) , কারণ অধিকাংশ সুশিক্ষিত জীববৈজ্ঞানিকরা তাই চিন্তা করছেন। একটি বাক্য হিসেবে নায়েকের এই কথা ভুল প্রমান করা অতি সহজ।

২৩. একের পর এক অখ্যাত ব্যক্তিদের নাম বলে যাচ্ছেন তিনি। আসলেই অখ্যাত নাকি এ নামে কোন মানুষই নেই। এখানে Whitemeat নামে কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এরা সবাই বিবর্তনের বিরুদ্ধে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন। এত যোগ্য ব্যক্তিদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যে ৬ জন বিবর্তনবিরোধীর নাম তিনি নিয়ে আসলেন, তাদের মধ্যে মাত্র তিনজনের নাম ঠিক হয়েছে। একজনের নাম একটু ভুল করেছেন। আর বাকি দুটা একেবারেই হয়নি।

২৪. Paremishia নামে কিছু নেই, এখানে বোধহয় নায়েক paramecium বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমিবা ও প্যারামিসিয়ম (যেগুলো পুরোপুরি আলাদা রাজ্যের জীব) এর মধ্য অনেক জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্য রয়েছে, যেখানে এইপ ও হোমো সেপিয়েন (একই পরিবারের জীব) এর মধ্যে জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্য তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অর্থাৎ নায়েক যেটা বলতে চাচ্ছেন তার পুরোপুরি বিপরীত।

২৫. আর এই Henses Crake টা-ই বা কে? ইনি নাকি আবার আণবিক জীববিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত অথরিটি। আবারও ভুল করলেন নায়েক, এটা আসলে Francis Crick হবে, ডিএনএ-র দ্বি-সূত্রক গঠনের আবিষ্কারক। ফ্রন্সিস ক্রিক বিবর্তনবাদে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন।

এইভাবে দেখা যাচ্ছে যে, মাত্র ৫২০ শব্দে বা ২৫ বাক্যে ডাঃ নায়েক ২৫টি সুস্পষ্ট মিথ্যা বলেছেন, অর্থাৎ প্রত্যেক বাক্যে একটি করে মিথ্যা। ডাঃ নায়েক অবশ্যই দক্ষ একজন বক্তা, কিন্তু এই পরিমানের ভুল নিয়মিত করলে, তিনি একজন অতি অযোগ্য ছাত্র হিসাবে বিবেচিত হবেন। তার কথা এতই ত্রুটিপূর্ণ যে সেগুলো শুধু লজ্জাজনক।

 

পুরোপুরি ভুল তথ্য

যেহেতু তার অধিকাংশ শ্রোতারা তার তথ্য সহজে চেক করতে পারে না, তাই নায়েক প্রায়ই মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করেন। এখানে কিছু উদাহরন দেওয়া হল—


নারী-পুরুষ অনুপাতের পরিসংখ্যান

 

বহুবিবাহের পক্ষে জাকির নায়েক যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন কিছু মিথ্যা পরিসংখ্যানের উপর। তিনি বলেছিলেন যে, বিশ্বে ও পশ্চিমাতে নারীদের সংখ্যা বেশী ও পুরুষদের সংখ্যা কম। জাকির নায়েক বলেন,

“If every woman got married to only one man, there would be over thirty million females in U.S.A, four million females in Great Britain, 5 million females in Germany and nine million females in Russia who would not find a husband. Thus the only two options before a woman who cannot find a husband is to marry a married man or to become public property.”২১ [ আমেরিকার প্রতিটি পুরুষ যদি একজন নারীকে বিবাহ করে তারপরেও তিন কোটির বেশি নারী থেকে যাবে, যারা নিজের জন্য কোনো স্বামী পাবে না। এভাবে চল্লিশ লাখের বেশি নারী ইংল্যান্ডে, পঞ্চাশ লাখের বেশি জার্মানিতে, এবং প্রায় এক কোটি নারী রাশিয়ায় রয়েছে যারা নিজেদের জন্যে কোনো স্বামী পাবে না। এই অবস্থায় নারীদের দুটি বিকল্প পথ থাকে—বহুবিবাহ অথবা তাকে হতে হবে “জনগণের সম্পত্তি”।]

নায়েকের ভক্তরা এই যুক্তি সহজে গ্রহন করে, কিন্তু তার পরিসংখ্যানগুলো যাচাই করেন না। বিভিন্ন স্বীকৃত উৎস, যেমন ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক (World Factbook – বিনামূল্যে ইন্টারনেটে দেখা যায়), জানাই একদম বিপরীত, যে পুরুষদের সংখ্যা নারীদের চেয়ে বেশী—

ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক— নারী-পুরুষ অনুপাত ২০০৯
(বিবাহের বয়সে — ১৫-৬৫ বছর বয়স)
  পুরুষ নারী ‘বাড়তি’পুরুষ
জার্মানী ১০৪ ১০০ ১০.৩ লক্ষ
যুক্তরাজ্য ১০৩ ১০০ ৫২লক্ষ
বিশ্ব মোট ১০২ ১০০ ৪.৩ কোটি

নায়েক এই বিষয়ে আরও বলেন,

“বিশ্বে নারীদের সংখ্যা পুরুষদের সংখ্যার চেয়ে বেশী”

মোটেও না— আসলে আনুমানিক হিসাবে বিশ্বে পুরুষদের সংখ্যা ৩০৫,৯৩,০৭,৬৪৭ এবং নারীদের সংখ্যা ৩০১,৯৪,৬৬,৮৮৭, অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি বাড়তি পুরুষ আছে দুনিয়ায়! আমি পাঠককে উৎসাহ্‌ দিচ্ছি, আমার এই পরিসংখ্যানগুলো যেকোন নির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটে চেক করে দেখুন।

 

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম

নায়েক প্রায়ই বলেন যে,

“অখ্রীস্টান ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম-ই একমাত্র ধর্ম যাতে ঈসা (আ)-এর উপর বিশ্বাস পোষণ ঈমান তথা বিশ্বাসের মৌলিক নীতি হিসেবে মনে করা হয়।”২২

সেই “তুলনামূলক ধর্মের পন্ডিত” জাকির নায়েক বোধহয় পৃথিবীর সপ্তম বড় ধর্মের অস্তিত্বের সম্পর্কে অজ্ঞ, অর্থাৎ বাহা’ই ধর্ম। এই ধর্ম ঈসা মসীহ্‌ ও মুহাম্মদ (সাঃ) দুজনকেই নবী হিসেবে স্বীকার করেন, এবং এই ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যা জৈন ও জরথ্রুস্ট ধর্মের চেয়েও বেশী। এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিট্যানিকা অনুযায়ী, বাহা’ই ধর্ম ২৪৭টি দেশে প্রতিষ্ঠিত এবং ২,১০০ বিভিন্ন জাতি ও ভাষার লোকদের মধ্যে এদের অনুসারী পাওয়া যায়, এবং এদের মোট সংখ্যা ৭০ লাখ। কিন্তু জাকির নায়েক এই ধর্মের কথা শুনেননি।

 

পিপীলিকার মধ্যে নেতা?

নায়েক খ্রীষ্টান ধর্মগ্রন্থকে অভিযোগ করে বলেন যে সেখানে ভুল তথ্য আছে, যেহেতু বাইবেলের মেসাল ৬ অধ্যায় ৭ আয়াতে আছে যে পিঁপড়াদের “হুকুম দেবার কেউ নেই, তার উপরে কোন পরিচালক বা শাসনকর্তা নেই” (মেসাল ৬:৭)। নায়েক বলেন যে সেটা বিজ্ঞান বিপরীত, কারণ পিঁপড়াদের মধ্যে একজন রানী থাকে এবং মজুরসরদার থাকে। পিঁপড়া সমাজের সম্পর্কে বিন্দুমাত্র গবেষণা করলে জানা যায়, পিঁপড়ার “রানী” কোন রকম নেতা নয়। উইকিপিডিয়া এইভাবে বর্ণনা করেছেন—

“The term “queen” is often deceptive, as the queen ant has very little control over the colony as a whole. She has no known authority or decision-making control; instead her sole function is to reproduce. Therefore the queen is best understood as the reproductive element of a colony rather than a leader.” ২৩ [“রানী” শব্দটা অনেকখানি ভ্রান্তিজনক, কারণ কলোনির উপরে রানীর কোনও হাত নেই। তার কোন অধিকার নেই বা সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই; তার একমাত্র ভূমিকা হল বংশবৃদ্ধি করা। এইজন্য রানীরা কোন নেতা নয় বরং কলোনির পুনরুৎপাদনশীলকারী। ]

তারপর নায়েক একটি স্পষ্ট মিথ্যা বলেন যে পিঁপড়াদের “ফোরমেন” থাকে (অর্থাৎ কর্মী দলের সরদার)। কিছু পিপীলিকাকলোনির এক শ্রেণী সৈন্য থাকে বটে, কিন্তু কোনও শ্রেণী নাই যেটাকে বলা যায় ‘মজুরসরদার’ বা foreman

 

ব্যাপক ধর্মান্তরীকরণ?

জাকির নায়েক প্রায়ই বলেন যে বিশাল ধর্মান্তরিতকরণের কারণে ইসলাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।২৪ এটা আসলে অর্ধসত্য। মোট হিসাবে ইসলাম বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম বটে, কিন্তু এর কারণ প্রধানত মুসলমানদের অনুপাতহীন জন্মহার, ধর্মান্তরিতকরণ নয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস প্রকাশিত পরিসংখ্যান বই থেকে বলা হয় যে ইসলাম বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম, সেখানেও বলা আছে যে ধর্মান্তরিতকরণের হিসাবে খ্রীষ্টধর্মই সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম।২৫ পাঠককে আবার দাওয়াত দিচ্ছি, আপনি নিজেই আমার এই পরিসংখ্যানগুলো যাচাই করে দেখুন।

 

মিথ্যা গুজব ছড়ানো

 

সর্বপ্রথম বিশ্বমানচিত্র নিয়ে


 

নায়েক বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা গল্প বলেন, যেমনঃ

“…সর্বপ্রথম বিশ্ব মানচিত্র এঁকেছেন মুসলমানরা।”২৬

মনে হচ্ছে নায়েক টলেমির কথা শুনেননি, যে মিসরীয় দার্শনিক ইসলামের ৫০০ বছর আগে প্রথম বিশ্ব মানচিত্র এঁকেছেন। নায়েক বোধহয় পিরি রেইসের ১৫১৩ খ্রীষ্টাব্দের মানচিত্রের কথা বলছেন (টলেমির ১৪০০ বছর পরে), যেটা হল বিশ্ব মানচিত্রাঙ্কনে ক্রমাগত বিবর্তনে একটি ছোট ধাপ। নায়েকের এই ভুল অনেকটা অন্য সব গুজবের মত, যেমন Bayer ফার্মাস্যুটিকাল “মাছি-পাখা-ঔষধ” দিয়ে এইড্‌সের চিকিৎসা আবিষ্কার করেছেন, অথবা Neil Armstrong চাঁদে আজান শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন (যেটা তিনি প্রায়ই নম্রভাবে অস্বীকার করেছেন২৭)।

ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে শ্রোতার অজ্ঞতা ব্যবহার করা

জাকির নায়েকের অধিকাংশ শ্রোতারা কখনও মাতৃভাষায় পুরা কোর’আন শরীফ বুঝে পড়েছেন, এবং খুবই কম পুরা বাইবেল পড়েছেন। যারা নিজেই এই পুরা কিতাবগুলো পড়েছেন, মুসলিম এবং অমুসলিম উভয়ই নায়েকের উদ্ধৃতির অপব্যবহার ঘৃণা করেন। জনগণের এই ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কেঅজ্ঞতার কারণেই জাকির নায়েক এমন অদ্ভুত কথা বলতে পারেন যে “আমি বাইবেল থেকে প্রমান করতে পারি যে ঈসা মসীহ্‌ ক্রুশবিদ্ধ হননি” এবং “…বাইবেলে, জেনেসিস ৩ অধ্যায় পড়লে, শুধুমাত্রবিবি হাওয়াকে দোষ দেওয়া হয় মানব জাতির পতনের জন্য।” তৌরাত ও ইঞ্জিলের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় থাকলে এই ধরনের দাবিকে শুধু পাগলামি বলতে হয়।

 

দ্রুতবেগে অর্ধসত্য বলা

নায়েকের পক্ষে অন্য ধর্মের কিতাব সম্পর্কে অপবাদ দিতে একটি অর্ধসত্য বলতে ৫ সেকণ্ড সময় লাগে, কিন্তু তথ্য ও যুক্তি দিয়ে সেই অর্ধসত্য ভুলপ্রমান করতে দশ মিনিট লাগে। নায়েক এই ধরনের কৌশলকে ভালভাবে ব্যবহার করেছেন উইলিয়ম ক্যাম্পবেলের সঙ্গে। তিনি উইলিয়ম ক্যাম্পবেলকে তর্কযুদ্ধর প্রস্তাব দিয়েছেন বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান নিয়ে, এবং বিতর্কটা এইভাবে হয়েছিল—

জাকির নায়েকের মাত্র দুই বা তিনটি নির্দিষ্ট তথাকথিত কোরআনের বৈজ্ঞানিক বিস্ময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ভুলপ্রমান করে ডাঃ ক্যাম্পবেল তার অধিকাংশ সময় শেষ করেন।

জাকির নায়েক ক্যাম্পবেলের যুক্তি ভালভাবে ভুলপ্রমান না করে বাইবেলকে আক্রমন করে বিশ-ত্রিশটা অপ্রাসঙ্গিক অর্ধসত্য বলেন। তারপর বিভিন্ন মুখস্থ আয়াতের ঠিকানার দ্রুতবেগে আবৃত্তি করে তিনি দর্শকদের মনোযোগ তার দুর্বল যুক্তি থেকে সরিয়ে দেন। এর পরে এইসব অপ্রাসঙ্গিক বিষয় ভুলপ্রমান করতে ক্যাম্পবেলের মোটেও সময় না থাকার কারণে তিনি হারিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রশ্ন-উত্তরের সময়ে একজন তীক্ষ্ণ মুসলমান মেয়ে নায়েককে বলেছেন, “কিন্তু আপনি ডাঃ ক্যাম্পবেলের সমালোচনার কোন উত্তর দেননি”—যেটা তিনি সত্যই করেননি।

এই হল তর্ক-বিতর্কের দুর্বল দিক—যে প্রতিযোগী অর্ধসত্য বেশী ব্যবহার করতে রাজি, তিনিই সাধারনত শ্রোতাদের দৃষ্টিতে জিতেন, কিন্তু যিনি অর্ধসত্য বা আয়াতের প্রসঙ্গহীন ভুলব্যাখ্যা বলতে অনিচ্ছুক, তিনি শ্রোতাদের দৃষ্টিতে হারান।

 

শ্রোতাদের কুসংস্কারের ব্যবহার

 

শূকরের গোশ্‌ত খাওয়া ও “স্ত্রী বদল করা”


 

যখন কোন যুক্তি খাটে না, নায়েক প্রায়ই জনগণের কুসংস্কারের ব্যবহার করেন—

“In America, most people consume pork. Many times after dance parties, they have swapping of wives; many say ‘you sleep with my wife and I will sleep with your wife.’ If you eat pigs then you behave like pigs.”
[ আমেরিকাতে, অধিকাংশ লোক শূকরের গোশ্‌ত খায় এবং অনেকসময় ড্যান্স পার্টির পরে নিজ স্ত্রীদের বদল করে এবং বলে তুমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন কর এবং আমি তোমার স্ত্রীর সঙ্গে শয়ন করব। শূকরের গোশ্‌ত খেলে শূকরের মত ব্যবহার করবেন। ২৮

বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞ নায়েক এখানে একটি তত্ত্ব দিচ্ছেন যে এক ধরনের পশুর গোশত খেলে আচরণ সেইরকম হয়ে যাবে। যেহেতু চীনারা আমেরিকানদের চেয়ে বেশী শুকর খায়, এরা কি বেশী “স্ত্রী বদল করে”?! তাহলে নায়েক যেহেতু মুরগীর গোশত বেশী খায় সেহেতু তিনি মুরগীর মত আচরণ করবেন? যুক্তিটা অত্যন্ত দুর্বল, কিন্তু শ্রোতাদের কুসংস্কারের কাছে সেটা কাটে। আমি অবশ্যই শুকরের গোশত খাই না, কিন্তু আমেরিকাতে দশ বছর পড়াশোনা করার সময়ে আমি নায়েকের এই “স্ত্রী বদল” করার প্রথা একবারেই শুনিনি, এবং অধিকাংশ আমেরিকান এমন জঘন্য প্রথা শুনলে আতঙ্কিত হবেন। নাস্তিক হলিউডে হয়ত এটা হয়েছে দু’এক বার, যেমন করে আমরা এরকম জঘন্য যৌন অপব্যবহারের কথা শুনি বলিউড ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন হোটেলেও হয়। কিন্ত এটা কি আসল যুক্তি বলা যায়? নায়েকের দাবিতে, তিনি শুধু বাস্তবতা বলেন, তত্ত্ব নয়।

 

কম্পিউটারের মত স্মরণশক্তি

নায়েক যখন কোন কঠিন যুক্তির সম্মুখীন হন, তিনি সাধারনত একটি লম্বা মুখস্ত-করা আয়াতের ঠিকানার তালিকা দিয়ে দর্শকদের মনযোগ অন্য দিকে নিয়ে যায়। সে আয়াতগুলো পুরোপুরি ভুল বা অপ্রাসঙ্গিক হলে কেউ ধরবে না কারণ শতকরা নিরানব্বইজন সেগুলো খুঁজে বের করবেনা। নায়েকের “পানির চক্র বৈজ্ঞানিক বিস্ময়” ভুলপ্রমান করার পরে তিনি এই কৌশল অবলম্বন করে আঠারোটি আয়াতের ঠিকানা দিয়ে বলেন যে সেসব আয়াতে পানি চক্রের “বিস্তারিত বর্ণনা” আছে। তার ভক্তরা খুশি হলেন, কিন্তু এইসব আয়াতের ঠিকানা খুঁজে বের করলে দেখা যায় সেখানে বিস্ময়কর কোন বর্ণনা নাই, শুধু স্পষ্টত প্রতীয়মান সত্য যেমন বৃষ্টি মেঘ থেকে পড়ে আর মেঘ বাতাসে ভেসে যায়।

 

পশ্চিমা সম্পর্কে দর্শকদের অজ্ঞতা অপব্যবহার করা

নায়েকের অধিকাংশ দর্শক কখনও পশ্চিমে যাননি, সেইজন্য তিনি পশ্চিমা সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা ব্যবহার করতে পারেন। একদিকে, তিনি আমেরিকান সমাজে সমকামিতা ও জেনার পরিসংখ্যানগুলো অতিমাত্রায় বাড়িয়ে বলেন, এমনকি তিনি বলেন যে “স্ত্রী বদল করা” হল একটি সাধারণ আমেরিকান প্রথা। যেকোন ব্যক্তি আসলে পশ্চিমাতে কয়েক বছর ঘুরে এসেছেন, এমন ব্যক্তির কাছে তার এই তথ্যগুলো পুরোপুরি অবিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু অধিকাংশ এশিয়ান মুসলমান এই ব্যঙ্গচিত্রণ কাহিনী গ্রহণ করেন।


‘পশ্চিমারা ইসলাম গ্রহণ করছেন’?


 

অন্যদিকে, তিনি পশ্চিমার সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দেন যে পশ্চিমাতে সবাই ইসলাম গ্রহণ করছেন। কিন্তু যারা পশ্চিমাতে ভ্রমণ করেছেন তারা জানেন যে পশ্চিমাতে ইসলামের বৃদ্ধির কারণ হল যে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান পশ্চিমাতে বাস করতে যাচ্ছেন। আমেরিকাতে মুসলমানদের সংখ্যা শতকরা ০.৬% (ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক ২০০৭) থেকে ১.৫% (ইন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিট্যানিকা ২০০৫)। আমেরিকান মুসলমানদের মধ্যে ২/৩ ভাগ জন্মগত বিদেশী, এবং বাকী মুসলমানরা অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান যারা প্রথমে প্রকাশ্য জাতিবিদ্বেষী দল Nation of Islam-এ যোগ দিয়ে পরে ইসলামে ঢুকে পড়ে। ধর্মান্তরিত মুসলমানদের সংখ্যা খুবই কম। এইভাবে দেখা যায় যে, নায়েকের পরিসংখ্যানগুলো ভারতীয় মুসলমানদের খুশি করে কিন্তু পশ্চিমার বাস্তব অবস্থার সম্পর্কে তাদের সরাসরি অভিজ্ঞতা নেই।


আমেরিকাতে খয়রাতি দান


 

নায়েকের বর্ণনায় আমেরিকান সমাজ খুবই কৃপণ এবং তিনি দাবি করেন যে আমেরিকানরা শরিয়ত-মত জাকাত (২.৫%) দিলে কোন দারিদ্রতা বা অপরাধ থাকত না। কিন্তু বাস্তব পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অন্যান্য সব দেশ থেকে আমেরিকানরা অনেক বেশী খয়রাতি দান দেয়, তাদের মোট আয়ের শতকরা হার হিসেবে (২%), এবং আমেরিকান এভ্যাঞ্জেলিকাল খ্রীষ্টানরা শতকরা তাদের মোট আয়ের ৪% জাকাত করে দেন।২৯ অর্থাৎ মুসলমানদের ২.৫% জাকাতের দ্বিগুণ বেশী এরা দিচ্ছেন। কোন সাংবাদিক যদি এমন আবোলতাবোল সংবাদপত্রে লিখতেন, তাহলে নিঃসন্দেহে বাস্তবতা বিকৃত করার জন্য তাঁর চাকরি বাদ দেওয়া হত।


আমেরিকাতে সমকামিতার হার

 

নায়েক লেখেন—

The U.S.A. as a whole has more than twenty-five million gays. This means that these people do not wish to marry women.” [“যুক্তরাষ্ট্রে ২ . ৫ কোটির অধিক পুরুষ-সমকামি আছে। অর্থাৎ এইসব লোক নারীদের বিয়ে করতে অনিচ্ছুক।”] ৩০

যথার্থ পরিসংখ্যা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষদের মধ্যে শুধুমাত্র শতকরা ২.৩% নিজেকে সমকামি বলে। অর্থাৎ তাদের সংখ্যা “২.৫ কোটির অধিক” নয় বরং ০.৩৫ কোটি; নায়েকের কথা থেকে ১০ গুন কম! কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এমন ভুল পরিসংখ্যান একটি পরীক্ষায় লিখলে, অধ্যাপক নিঃসন্দেহে তাঁকে ফেল করতেন।


পশ্চিমাতে ঘুষ ও দুর্নীতি

 

“পশ্চিমা কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন?” নামক ভিডিওতে নায়েক বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন যে পশ্চিমার ঘুষ ও দুর্নীতিগ্রস্থ সমাজের জন্যে কোরআনের সমাধান লাগে। শুনতে ভাল লাগে, কিন্তু ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিশ্বমানচিত্র দেখলে জানা যায় যে বাস্তবে কেবলমাত্র যেসব এলাকায় প্রোটেস্টান্ট রেফর্মেশনের পরে বাইবেলের গুরুত্ব দেওয়া হয় সেখানেই দুর্নীতির সমস্যা নেই। বাস্তব দলীল অনুযায়ী ঈসা মসীহের শিক্ষা দুর্নীতি রোধের সবচেয়ে কার্যকর সমাধান বলা যায়—

corruption map

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল দুর্নীতি মানচিত্র সিপিআই ২০০৫
(প্রটেস্ট্যান্ট রেফোর্মেশনের এলাকা চিহ্নিত)
[ কালো জায়গায় দুর্নীতি বেশী, সাদা জায়গাগুলোতে দুর্নীতি কম)

 


হিজাব ও নারী-নির্যাতন

 

নায়েকের দাবি, হিজাব হল নারী নির্যাতনের একমাত্র সমাধান। যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের উচ্চ হার উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন যে সেখানে ইসলামি শরিয়ত চালু করলে ধর্ষণ কমে যেত।৩১ তার পরিসংখ্যানগুলো শুনতে বিশ্বাস করার মত। কিন্তু যে কেউ পশ্চিমা ও প্রাচ্যে ঘুরেছেন তারা জানে যে এশিয়াতে পারিবারিক ইজ্জত রক্ষা করার প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয় যে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশকে জানানো হয় না, যার কারণে সেগুলো পরিসংখ্যানে দেওয়া হয় না। মিশরে, যেখানে হিজাব ব্যবহার করা হয়, সেখানে নারী-নির্যাতন এবং ইভ-টিজিং নিয়ে অনেক সমস্যা আছে। মিসরীয় সংস্থা ইজিপশান সেন্টার ফর ওয়িমেন্স রাইট্‌স একটি বিরাট জরিপ করেছেন। দুই হাজার মিসরীয় নারীর মধ্যে ৮৩% কোন রকম উৎপীড়ন ভোগ করেছেন। এই প্রতিবেদনের লেখক, নিহাদ আবৌল-কুমসান, বলেন অনেক সময়ে নারীকে তার পোষাকের কারণে দোষ দেওয়া হয়—

 

“আমরা যখন তাদের জিজ্ঞেস করেছি উৎপীড়নের সময়ে তারা কী রকমের পোষাক পরেছিলেন, শতকরা ৭০% এর বেশী বলতেন যে এরা তখন হিজাব পরেছিলেন।

আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, জরিপে প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ পুরুষ অবাধে স্বীকার করেছেন যে এরা একজন নারীকে উৎপীড়ন করেছেন কোন এক সময়ে।”৩২

তাই আমরা দেখি যে পরিসংখ্যানগুলো বিপরীত দেখায়—মিসরে অধিকাংশ উৎপীড়িত নারীরা সেই মূহুর্তে হিজাব পরেছিলেন। শালীন পোষাক পরা অবশ্যই ভাল, কিন্তু নিপীড়িতকে দোষ দেওয়া ঠিক না।

 

বাছাই করা বুদ্ধিজীবীর উদ্ধৃতি

পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীর ইসলামের সুনাম করার ছোট উদ্ধৃতি দিতে জাকির নায়েকের কাছ খুব ভাল লাগে। কিন্তু এসব বুদ্ধিজীবীরা আবার নায়েকের কট্টরপন্থী মতবাদের একদম বিপক্ষে দাঁড়ায়। আসলে বিশ্বের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীরা, মুসলিম বা অমুসলিম উভয়ই, নায়েকের ওয়াহাবি দৃষ্টিভঙ্গি অশ্রদ্ধা করেন।

 

ধর্মগ্রন্থের প্রসঙ্গবহির্ভূত উদ্ধৃতি

কিতাবুল মোকাদ্দসে মুহাম্মাদ(সাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বানী হিসেবে জাকির নায়েক প্রায়ই উল্লেখ করেন “বুক অভ আইজায়ার [ইশাইয়া], অধ্যায় ১২, অনুচ্ছেদ ২৯”৩৩ (আসলে অধ্যায় ২৯ , ১২ আয়াত !)। জাকির নায়েক যেভাবে উদ্ধৃতি দেন, মনে হয় সেটা একটি আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বানী—

“একজন নবীকে যিনি শিক্ষিত নয়, তাকে একটি কিতাব দেওয়া হবে।” ৩৪

কিন্তু যদি আমরা যেকোন অনুবাদের কিতাবুল মোকাদ্দস নিজে খুলে দেখি, আমরা লক্ষ করবো যে নায়েক চতুর ভাবে “নবী” শব্দটা উদ্ধৃতির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন যেখানে মূল হিব্রু ভাষায় সেই শব্দ নেই—

“যে তেলাওয়াত করতে জানে না তাকে কিতাবটা দিয়ে যদি বলা হয়, “দয়া করে এটা তেলাওয়াত করুন,” তবে জবাবে সে বলবে, “আমি তেলাওয়াত করতে জানি না।” (ইশাইয়া ২৯:১২)

এখন যদি আমরা কিতাবে এই অধ্যায়ের প্রসঙ্গ মূল্যায়ন করি, তাহলে বোঝা যায় যে এখানে নবী ইশাইয়ার শ্রোতাদের অহেতুক অজুহাত নিয়ে বলা হচ্ছে। এখানে গোটা অনুচ্ছেদটা তুলে দেওয়া হল—

“গোটা দর্শনটাই তোমাদের কাছে কেবল সীলমোহর করা গুটানো-কিতাবের মত হয়েছে। যে তেলাওয়াত করতে জানে তাকে যদি সেই কিতাবটা দিয়ে বলা হয়, “দয়া করে এটা তেলাওয়াত করুন,” তবে জবাবে সে বলবে, “আমি পারব না, কারণ এটা সীলমোহর করা হয়েছে।” কিংবা যে তেলাওয়াত করতে জানে না তাকে কিতাবটা দিয়ে যদি বলা হয়, “দয়া করে এটা তেলাওয়াত করুন,” তবে জবাবে সে বলবে, “আমি তেলাওয়াত করতে জানি না।” দ্বীন-দুনিয়ার মালিক বলছেন, “এই লোকেরা মুখেই আমার এবাদত করে আর মুখেই আমাকে সম্মান করে, কিন্তু তাদের দিল আমার কাছ থেকে দূরে থাকে।” (ইশাইয়া ২৯:১১-১৩)

তাহলে, এই আয়াতটি যদি একটা ভবিষ্যদ্বাণীই হতো (বিশ্লেষণে যদিও এটা আসলে কোন ভবিষ্যদ্বানী নয়), তবে তো মানব জাতির ইতিহাস জুড়ে সকল শিক্ষিত (১১ আয়াত) ও অশিক্ষিত (১২ আয়াত) ব্যাক্তির দ্বারাই এই ভবিষ্যদ্বানী পূর্ণ করা সম্ভব! আসলে এই আয়াতে সেই সব লোকদের বিষয়ে বলা হয়েছে যারা ইশাইয়া নবীর ভবিষ্যদ্বানীর বিরুদ্ধে অহেতুক অজুহাত দাঁড় করায়। জাকির নায়েক তার দর্শকদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটা ভ্রান্ত ধারণা দিচ্ছেন এবং তাতে তার সততার উপর সন্দেহ সৃষ্টি করছেন।

 

মনগড়া শব্দার্থ

যেহেতু তাঁর অধিকাংশ দর্শকরা প্রাচীন আরবী, হিব্রু বা গ্রিক ভাষার পণ্ডিত নয়, জাকির নায়েক স্বাধীনভাবে নতুন নতুন শব্দার্থ আবিষ্কার করেন যেগুলো কোন ভাষাতত্ত্ববিদ মানবেনা। যেমনঃ

 

আরবী #১— “নূর” অনুবাদ

 

বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ের পক্ষে নায়েকের একটি যুক্তি হল যে কোরআনে সূর্যের আলোকে সরাসরি আলো (“সিরাজ”) বলা হয় কিন্তু চাঁদের আলোকে বলা হয় প্রতিফলিত আলো—

“কত মহান তিনি যিনি নভোমণ্ডলে সৃষ্টি করিয়াছেন রাশিচক্র এবং উহাতে স্থাপন করিয়াছেন প্রদীপ ও জ্যোতির্ময় চন্দ্র।” (সূরা ফুরকান ২৫:৬১)

এই ব্যাখ্যায় নায়েকের প্রথম সমস্যাটা হলো যে আরবী “নূর” (نُور) শব্দটা শুধুমাত্র “আলো”কে বোঝায়; এই শব্দ দিয়ে “প্রতিফলিত” বোঝানো হয় তা কোন আরবী অভিধান বা শব্দকোষে নেই। কিন্তু যুক্তিতর্কের খাতিরে আমরা যদি নায়েকের শব্দার্থগুলো ধরে নিই, তাহলে এই-ও বলতে হবে যে আল্লাহতা’লা (যার উপাধি “আন-নূর”) হলো শুধুমাত্র “প্রতিফলিত আলো”, কিন্তু মুহাম্মদ (সাঃ) (যাকে সূরা আহ্‌যাব ৪৬ আয়াতে বলা হয় “সিরাজ” বা আলোর উৎস) হলো সেই প্রতিফলিত আলোর (অর্থাৎ আল্লাহ্‌র) উৎস (নাউজুবিল্লাহ!)।

আরবী #২ – ‘দাহাহা’-এর ‘ডিম’ অনুবাদ

গত ১৪০০ বছর ধরে সূরা ৭৯:৩০ সবসময় “বিস্তৃত” দিয়ে অনুবাদ হয়ে আসছে—

“…এবং পৃথিবীকে ইহার পর বিস্তৃত করিয়াছেন।” (সূরা নাযি’আত ৭৯:৩০)

কিন্তু নায়েক বলেন যে دَحَهَا (“দাহাহা”) শব্দের আসল অর্থ হল “বিস্তৃত” নয় বরং “উটপাখির ডিম” (!), এবং এইভাবে নায়েকের নতুন অনুবাদ হয়, “এবং পৃথিবীকে ইহার পর ডিম-আকারে সৃষ্টি করেছেন।”

কোন স্বীকৃত আরবী অভিধানে এই دَحَهَا শব্দটির অর্থ “উটপাখির ডিম” পাবেন না।” বিগত দুই শতকের আগে, কোনো আরবী আলেম এমনভাবে এই আয়াতটি অনুবাদ করেছেন; যেমন ইউসুফ আলী, পিক্‌থাল, শাকির, আসাদ, এবং দাউদ, যারা সারা জীবন ব্যয় করেছেন কোরআনের সঠিক অনুবাদ করতে। আমরা কাকে বিশ্বাস করব—একজন প্রকৃত কোরআনি-আরবীর ভাষাতত্ত্ববিদ, নাকি নায়েকের মত একজন ওয়াহাবী টেলিভিশন প্রচারক? আব্দুল রাহমান লোমাক যেমন বলেছেন—

এই “ডিম” ব্যাখ্যা আবার “nonsense” (আজগুবি) এই কারণে, যে ডিমের আকার আসলে পৃথিবীর ঠিক উলটা— ডিমের আকার হল দু’প্রান্তে সম্প্রসারিত গোলাকার (prolate spheroid), কিন্তু পৃথিবীর আকার হল দু’প্রান্তে চেপ্টা গোলাকার (oblate spheroid)।

উটপাখির ডিম নয়; ঘোড়ার ডিম!

 

হিব্রুতে মনগড়া শব্দার্থ

 

নায়েক হিব্রু বাইবেলে যেকোন ম-হ-ম-দ বানানের শব্দ খুঁজে বের করে সেটাকে নবীজীর আগমনের ভবিষ্যদ্বানী হিসেবে প্রচার করে। বাইবেলের সোলায়মান ৩৫ কিতাবের ৫:১৬ আয়াতে তিনি এমন বানানের একটি শব্দ খুঁজে পেয়েছেন—

“তাঁর মুখখানা খুব মিষ্টি, তাঁর সবই সুন্দর।
হে জেরুজালেমের মেয়েরা, উনিই আমার প্রিয়, আমার বন্ধু।” (সোলায়মান ৫:১৬)

যে প্রসঙ্গের মধ্যে এই উদ্ধৃতি বলা হয়েছে, জাকির নায়েক তা খুব সাবধানে লুকিয়ে রেখে দাবি করেন যে যেহেতু “প্রেমিক” শব্দ হিব্রু ভাষায় হয় “מחמד” (ম-হ-ম-দ, আরবী অক্ষরে محمد), সেহেতু এটি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর একটি ভবিষ্যদ্বানী। অথচ এই আয়াতটি এমন একটা অধ্যায়ের অংশ যেখানে বিয়ের সময়ে একজন কনে তার বরের বিস্তারিত বর্ণনা দিচ্ছেন। তথাপি নায়েকের নতুন অনুবাদ অনুযায়ী “প্রেমিক” এই বিশেষণকে বাদ দিয়ে একটা নাম বসাতে হবে যা এই বাক্যের ব্যাকারণের সঙ্গে খাপ খায় না—

“তাঁর মুখখানা খুব মিষ্টি, তাঁর সবই মুহাম্মদ।(וכלו מחמדים)” (সোলায়মান ৫:১৬)

এই পুরো অধ্যায়টা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এই আয়াতে মুহাম্মদ (স)-এর বিষয়ে কিছু বলা হয় নি এবং এটি কোন ভবিষ্যদ্বানীও নয়, বরং এমন ধরণের দাবি করা শুধুমাত্র মানুষকে ভ্রান্ত করার একটা চেষ্টা। নায়েকের এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে আমরা এই ধরণের আরও অনেক ‘ভবিষ্যদ্বানী’ কিতাবুল মোকাদ্দসে আবিস্কার করতে পারি । হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)-এর ঠিক আগে ও পরে মানী এবং মিরজা হুসেইন আলী (বাহাউল্লাহ) নামক দু’জন অ-মুসলিম নবী ‘কিতাব’ নিয়ে এসে দাবি করেছেন যে তারাও ঈসা নবীর পরে আগত নবী। জাকির নায়েকের এই সন্দেহজনক পদ্ধতি আমরা যদি এই লোকদের জন্য ব্যবহার করি, তাহলে আমরা দেখি যে, বাহাউল্লাহ্‌ (חסין) নামটি জবুর শরীফ ৮৯.৮ আয়াতে উল্লেখ করা আছে এবং মানী (מנּי) নামটা গোটা কিতাবুল মোকাদ্দসে ১৮টি জায়গায় উল্লেখ করা আছে! আমরা তাহলে কী স্বীকার করে নিব যে এই আয়াতগুলো অমুসলিম নবীদের বিষয়েই ভবিষ্যদ্বানী দিচ্ছে?

 

গ্রিক ভাষায় মনগড়া শব্দার্থ

 

ইঞ্জিলের গ্রিক অনুচ্ছেদ ইউহোন্না ১:১-৩ নিয়ে জাকির নায়েক একটি যুক্তি অযথার্থভাবে নকল করেছেন আহমেদ দিদাত থেকে—

“The first time God occurs in the quotation is “Hotheos” which literally means “the God” i.e. “And the Word was with God”. But the second time when the word “God” appears in the quotation, the Greek word used is “Tontheos”, which means “a god” i.e. “and the word was with god.” In Hebrew there is nothing like Capital ‘G’ and small ‘g’ like in the English language. Thus Hotheos is ‘the God’ with capital ‘G’ and Tontheos is ‘a god’ with small ‘g’.৩৬

ভুল—“হোথেওস” (ὁθεός) কথাটা পুরা অধ্যায়ে একবারও ব্যবহার হয় না, এবং “তন্‌থেওস” (τὸνθεός) হল ব্যাকরণগত ভুল (কথাটা আসলে “তন্‌থেওন”; τὸνθεόν, যে কথাটা ইউহোন্নাতে আল্লাহ্‌তা’লা বোঝাতে প্রায়ই ব্যবহার করা হয়)। জাকির নায়েক তাঁর যুক্তির মাঝখানে ভুলে যায় কোন ভাষা নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে যখন তিনি হঠাৎ করে হিব্রু নিয়ে আলোচনা করেন আবার গ্রিক নিয়ে ফিরে যান। স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে নায়েক গ্রিক বোঝে না, কিন্তু যারা গ্রিক ভাষা সত্যিই জানে, তাদের কাছে নায়েকের এই আবোলতাবোল কথা বুঝতে কঠিন এবং বুঝার পরেও যুক্তিটা অত্যন্ত দুর্বল মনে হয়।

 

ধর্মগ্রন্থের বিকৃত উপস্থাপনা

 

বাইবেলে সবকিছু কি নারীদেরই দোষ?


 

বিশেষ করে বাইবেলের ক্ষেত্রে, জাকির নায়েক সেটার প্রত্যক্ষ শিক্ষাকে বিকৃত করে নতুন একটি কল্পিত উপস্থাপনা দিয়ে সেটাকে ভুলপ্রমান করেন। উদাহরণস্বরূপ, নারীর মর্যাদা নিয়ে নায়েক বলেনঃ

‘বাইবেলে, পয়দায়েশ ৩ অধ্যায় পড়লে, পুরা মানব জাতির পতনের জন্য শুধুমাত্র বিবি হাওয়া (আঃ)-কে দোষ দেওয়া হয়।”

মনে হচ্ছে জাকির নায়েক নিজেই বাইবেলের এই অধ্যায় পড়েননি, কারণ সেই অধ্যায়ে আল্লাহ্‌তা’লা বিবি হাওয়া (আঃ)-কে মাত্র একটি আয়াতের অভিশাপ বা দোষ দেন, কিন্তু হযরত আদম (আঃ)-কে দোষ দিয়ে আল্লাহ্‌তা’লা তাকে তিনগুণ বেশী অভিশাপ ও শাস্তি দেন! আবার বাইবেলের অন্যান্য জায়গায় সাধারনত মানব জাতির পতনের দোষকে শুধুমাত্র আদমের ঘাড়ে চাপানো হয় (১ করিন্থীয় ১৫:২২, রোমীয় ৫:১৪, ৫:১২, হোশিয়া ৬:৭, ইত্যাদি)। নায়েকের এই অভিযোগ অর্থহীন ও ভ্রান্তমূলক।

 

অসম নীতি

জাকির নায়েক পশ্চিমার খ্রীষ্টানদের প্রশংসা করেন কারণ এরা তাদের ছেলে-মেয়েকে ইসলাম গ্রহণ করতে কোন বাঁধা দেন না বা ধর্মান্তরিত আত্মীয়স্বজনকে চাপ দেননা, কিন্তু তিনি জোরে প্রচার করেন যে কোন বংশোদ্ভূত মুসলমান অন্য কোন ধর্ম পছন্দ করলে তাকে হত্যা করা উচিত।

 

টেলিভিশন যোগাযোগ মাধ্যম

বই ও রচনার মাধ্যম উচ্চ ও যৌক্তিক চিন্তা জন্মাই, কিন্তু টেলেভিশন মাধ্যমে সাধারনত দুর্বল যুক্তি ঢেকে রাখা যায় এবং অবাস্তব বিভ্রান্ত ভাব তৈরি করার সহজ। কেউ pause বাটন টিপে বক্তার তথ্য প্রতিপাদন করেননা। টেলেভিশন হল আমোদপ্রমোদের যোগাযোগমাধ্যম, ধর্মীয় আলোচনা নয়, এবং জাকির নায়েক হলিউডের মেথডগুলো ব্যবহার করে লন্ডনের রাস্তায় হাটতে হাটতে নাটকীয় promotional video shots দিয়ে নিজের জন্যে একটি রক-স্টার ভাব তৈরি করেছেন।

 

বিতর্কে সত্যিই অপরাজিত?

নায়েকের বই-পুস্তকে বলা হয় যে অন্য ধর্মের কেহ জাকির নায়েকের সংগে বিতর্ক করতে কারো সাহস নাই। নায়েকের বইপুস্তকে প্রায়ই বিস্তারিতভাবে লেখা থাকে কীভাবে পোপ বেনেডিক্তের প্রতি নায়েকের বিতর্কের প্রস্তাবে পোপ থেকে কোন উত্তর আসেনি। পোপ যে উত্তর দেননি তা পুরোপুরি স্বাভাবিক, কারণ টেলিভিশন প্রচারকদের তর্ক করা পোপ বা মুফতির মত ধর্মীয় নেতার ভূমিকা নয়। বিশ্ব ধর্মীয় নেতা অন্য ধর্মীয় নেতাদের সংগে আলোচনা করেন (যেমন দেওবন্দী উলেমা বা মুফতি), “ঘাইর মুকাল্লিদীন” টেলেভিশন প্রচারকদের সঙ্গে নয় যারা নিজ ধর্মীয় নেতা দ্বারা অভিযুক্ত। জাকির নায়েকের বিশেষজ্ঞতা হল ¬interfaith debate (অন্যধর্মের সঙ্গে বিতর্ক), কিন্তু তিনি এখনও কোন বড় মাপের খ্রীষ্টান বিতর্কবিদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি, যেমন ডঃ জেমস ওয়াইট, জে স্মিথ্‌, ডেভিড উড, স্যাম শামাউন, ডি আরাবিক খ্রীষ্টান পার্স্পেক্টিভ্ টীম , সাক্ষী ইন্ডিয়ান আপলোজেটিক্স নেটওয়ার্ক—-সবই যারা অনেক দিন আগে থেকে নায়েককে চ্যালেঞ্জ করেছেন কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন উত্তর পাননি। এই রকম সেরা খ্রীষ্টান তর্কবিদের সঙ্গে আলোচনা না করে জাকির নায়েক শুধু মঞ্চে দাঁড়ায় এমন লোকদের সঙ্গে যারা বয়স্ক বা তর্কে দুর্বল, অথবা যারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। আবার জাকির নায়েক যদি ব্রিটিশ উদারপন্থী মুসলমান এড হোসেনের মত কোন শিক্ষিত মুসলমানের সঙ্গে তর্ক করতেন, বেশ ভাল হত।

নায়েকের এইসব মিথ্যা তথ্যের তালিকা দিয়ে আমার লক্ষ্য তাঁকে লজ্জা দেওয়া নয় বরং তার দর্শকদের গভীরভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করা। যদি নায়েক শুধু সততা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে কেন তিনি এত বেশী ভুল পরিসংখ্যান, অতথ্য, অর্ধসত্য ও অসম নীতি ব্যবহার করে থাকেন?

* * *
  1. দারুল ইফতা, দারুল উলুম দেওবন্দ-ভারত প্রশ্ন #৭০৭৭,
    (http://darulifta-deoband.org/viewfatwa.jsp?ID=7077)
  2. দারুল ইফতা, দারুল উলুম দেওবন্দ-ভারত প্রশ্ন #১৭১,
    (http://darulifta-deoband.org/viewfatwa.jsp?ID=171)
  3. দারুল ইফতা, দারুল উলুম দেওবন্দ-ভারত প্রশ্ন #১১০,
    (http://darulifta-deoband.org/viewfatwa.jsp?ID=110)
  4. দারুল উলুম টাইম্স অব ইন্ডিয়া লিখেন, “A day after a Lucknow-based mufti issued a fatwa against Naik, a group of Sunni ulema from Mumbai, on Saturday, accused him of working at the behest of Saudi Arabia-backed Wahabis and Deobandis. The group also called for Naik’s immediate arrest and a ban on his conference scheduled to be held at the Somaiya ground in Sion from November 14 to 23. The group has also threatened to disrupt Naik’s Islamic conference if the state government did not cancel it.”
    – মুহাম্মাদ ওয়াজিহুদ্দিন, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ৮ নভেম্বর, ২০০৮ link here
  5. http://sunninews.wordpress.com/2010/06/29/muslims-supported-the-u-k-ban-on-zakir-naik/
  6. মুহাম্মাদ ওয়াজিহুদ্দিন, TNN, Asia News, ১৯ নভেম্বর, ২০০৮, http://english.siamdailynews.com.
  7. Ibid.
  8. শাহ্নাওয়াজ ওয়ারসি, নভেম্বর ১৩, ২০০৮, www.sunninews.wordpress.com
  9. ইবরাহিম তাহিল, রাজা একাডেমী, নোভ ৮, ২০০৮ (http://sunninewsonline.com/?p=325).
  10. ইবন সা’দ, তাবাকাত আল-কুবরা, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৬; সাহাবা আব্দুল্লাহ্ ইবনে হানজালা (রাঃ) থেকে বর্ণিত।
  11. শেখ আল-হাদিস মুহাম্মাদ জাকারিয়া, আউ খানার আল মাসালিক, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪৫০।
  12. দেখুন ইকবাল লতিফ, “Why the clergy has made our heroes our heretics?” http://www.globalpolitician.com/22333-islam
  13. মুহাম্মদ মোস্তফা বিজনৌরী সম্পাদিত, ইসলাম এর ‘আক্বলিয়াত, লাহোর : ইদারাহ্‌ ইসলামিয়াত, ১৯৯৪, ৪০৩-৪২১.
  14. Daniel Golden, Strange Bedfellows: Western Scholars Play Key Role in Touting `Science’ of the Quran. Wall Street Journal, Jan 23, 2002. pg. A.1.
  15. When Science Teaching Becomes A Subversive Activity By Pervez Hoodbhoy
  16. Taner Edis, “Quran-science”: Scientific miracles from the 7th century? (retrieved from http://www2.truman.edu/~edis/writings/articles/quran-science.html)
  17. Abu Ammar Yasir Qadhi, An Introduction to the Sciences of the Quran Footnote, p.282.
  18. Abdus Salam “Foreword”, in Hoodbhoy, Pervez Islam and Science: Religious Orthodoxy and the Battle for Rationality, 1991: ix
  19. Abdullah Saeed, ‘The Charge of Distortion of Jewish and Christian Scriptures’, in The Muslim World, Vol 92, Fall 2002, p. 434.
  20. Szent-Györgyi, Albert. 1970. The Crazy Ape. New York: Philosophical Library.
  21. http://www.irf.net/irf/dtp/dawah_tech/mcqnm1.htm, see also Zakir Naik, Answer to Non-Muslims’ Common Questions about Islam, Islamic Bookstore: Kolkata.
  22. ডাঃ জাকির নায়েক, বিভিন্ন ধর্মে আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা (পিস পাবলিকেশন, ঢাকা ২০০৮), পৃষ্ঠা ২৮.
  23. “queen ant”, Wikipedia.org, September 29, 2009 (http://en.wikipedia.org/wiki/Queen_ant)
  24. ডাঃ জাকির নায়েক, পশ্চিমা কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন? (পিস পাবলিকেশন, ঢাকা ২০০৮).
  25. http://en.wikipedia.org/wiki/Fastest-growing_religion
  26. ডাঃ জাকির নায়েক, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব (পিস পাবলিকেশন, ঢাকা ২০০৮).
  27. মালয়েশিয়ার প্রধান ইংরেজী সংবাদপত্র The Star নিইল আর্মস্ট্রোং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এই গুজব ভেঙ্গেছেন (দেখুন http://www.thestar.com.my/news/story.asp?file=/2005/9/7/nation/11971532&sec=nation)
  28. . English: Dr. Zakir Naik, Answers to Non-Muslims’ Common Questions about Islam (Islamic Bookstore, Kolkata), p.44. (বাংলা অনুবাদঃ মোঃ আব্দুল কাদের মিয়া, ডাঃ জাকির নায়েক, ইসলামের উপর ৪০টি অভিযোগ ও তার প্রমাণ ভিত্তিক জবাব, পিস পাবলিকেশন, ২০০৮, পৃষ্ঠা ৪৫)
  29. http://www.generousgiving.org/
  30. Zakir Naik, Most Common Questions Asked by Non-Muslims. http://www.irf.net/irf/dtp/dawah_tech/mcqnm1.htm
  31. See for example, Naik, Answers to Non-Muslims’ Common Questions About Islam, (Islamic Bookstore, Kolkata)
  32. Egyptian Women learn to fight back, BBC News, Wednesday, 18 March 2009 (http://news.bbc.co.uk/2/hi/7936071.stm)
  33. ডাঃ জাকির নায়েক, ইসলাম ও খ্রীস্ট ধর্মের সাদৃশ্য, পিস পাবলিকেশন-ঢাকা, ২০০৮, পৃষ্ঠা ১৯
  34. ডাঃ জাকির নায়েক, কুরআন কি আল্লাহ্‌র বাণী?, পিস পাবলিকেশন-ঢাকা, ২০০৮, ৪৯
  35. ‘সোলায়মান’ (שיר השירים) কিতাবটার ইংরেজি নাম হয় Song of Solomon.
  36. http://www.irf.net/irf/dtp/dawah_tech/t22/pg1.htm

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *