বাইবেলের নবীগণের “ব্যভিচার-ধর্ষণ ও হত্যা”?

জাগো খ্রীষ্টান জাগো!
বাইবেলে নবীগণ, ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ-এর ব্যভিচার-ধর্ষণ ও হত্যা!

এই লেখার মধ্যে বেশির ভাগ হল অর্ধসত্য, ভুল ব্যাখ্যা, এবং কিছু প্রকাশ্য মিথ্যাও আছে। কিন্তু যেখানে যেখানে বাইবেলে খারাপ ব্যবহারের বর্ণনা আছে – ধর্ষণ, হত্যা, মদপান, মিথ্যা ইত্যাদি – আমরা সম্পূর্ণ একমত যে এগুলো খারাপ এবং আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীত। সেটা কিতাবে লেখাও আছে এবং তাদেরকে সেইভাবে শাস্তিও দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু নবীদের ভূমিকা সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা দরকার। প্রচলিত ইসলামী ধারণা অনুযায়ী নবীগণ মূলত আদর্শ হিসেবে আল্লাহ পাঠিয়েছিলেন, যার জন্য সবাই মনে করে যে তারা প্রত্যেকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ছিলেন। কিন্তু আল্লাহ কি সত্যি শুধু এই উদ্দেশ্যে নবীদের পাঠিয়েছিলেন? নিষ্পাপ জীবন দেখানোর জন্য? কোরআন শরীফ থেকেই আমরা জানি যে নবীগণ নিষ্পাপ ছিলেন না। তাদের পাপ ও ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে হযরত আদম থেকে শুরু করে ইবরাহিম, নূহ, দাউদ, ইউনুস, এমনকি নবীজীর সম্বন্ধেও (সূরা মুহম্মদ ১৯ আয়াত) পাপ ও ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে। প্রধান নবীগণের মধ্যে শুধুমাত্র ঈসা মসীহের সম্বন্ধে কোন পাপের কথা বলা হয়নি।

কিতাবুল মোকাদ্দস অনুযায়ী, নবীরা নিষ্পাপ ছিলেন না। তারা যখন আল্লাহর ইচ্ছামত চলত তখন আমরা দেখতে পারি আল্লাহ তাদের উপর খুশি ছিলেন এবং তাদের আশীর্বাদ করলেন, কিন্তু তারা যখন পাপ করলেন তখন আল্লাহ তাদের ধমক দিয়ে শাস্তি দিলেন। এইভাবে তাদের ভালো আদর্শ থেকেও আমরা শিখতে পারি, তাদের খারাপ আদর্শ থেকে আমরা সেই খারাপ রাস্তায় না যাওয়ার জন্য সতর্ক থাকতে পারি। এর অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। যেমন হযরত দাউদ জেনা করলেন, এবং এই জেনার জন্য আল্লাহ তার উপর অনেক অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাকে শাস্তি দিলেন। একই ভাবে হযরত সোলায়মানের রাজ্যত্বের শুরুতে তিনি আল্লাহভক্ত ছিলেন, কিন্তু পরে আল্লাহকে ভুলে যেয়ে তিনি অনেক বিবাহ করে অনেক ধন ও সৈন্যদল জমা করলেন তৌরাতের নিয়মের বিরুদ্ধে, তাই আল্লাহ তাকে শাস্তি দিলেন।

তাদের ভালো কাজের আদর্শ থেকেও আমরা শিখতে পারি, তাদের খারাপ আদর্শ থেকে আমরা সেই খারাপ রাস্তায় না যাওয়ার জন্য সতর্ক থাকতে পারি।

কিতাবুল মোকাদ্দসের বর্ণনায় নবী-রাসূলগণ ও তাদের সন্তানগণ ছিলেন ব্যভিচারী ও ধর্ষক (আদিপুস্তক ১৯:৩৩-৩৮, আদিপুস্তক ৩৫:২২, আদিপুস্তক ৩৮:১৫-১৮, আদিপুস্তক ৩৮:২৭-৩০)

লুতের পাপ (পয়দায়েশ ১৯:৩৩-৩৮) – এটা অবশ্যই একটি জঘন্য অত্যন্ত খারাপ ঘটনার ইতিহাস। আমরা যখন এই অধ্যায় পড়ি আমাদের কাছে এগুলো অবিশাস্য এবং বিশ্রী লাগে, কিন্তু তাও আসল বিষয়টা ভালভাবে বুঝে নেয়া প্রয়োজন।

প্রথম প্রশ্ন হল, লুত কতটুকু দায়ী ছিল? প্রথমত, মাতাল হওয়া অবশ্য তার একটি গুনাহ্‌ ছিল, কিন্তু তখনও মদের বিরুদ্ধে কোন বিধান দেওয়া হয় নি। দ্বিতীয়ত, এই ব্যভিচার গুনাহের জন্য প্রধানত লুত দায়ী নন কারণ “কখন সে শুলো আর কখনই বা উঠে গেল লুত তা টেরও পেলেন না” (৩৩ আয়াত)। সজ্ঞান অবস্থায় লুত এমন জঘন্য কাজ কখনও করত না, এইজন্য তার মেয়েরা ষড়যন্ত্র করে তাকে অচেতন করার জন্য তাকে মদ খাওয়ালো। এতে বোঝা যায় যে এই জঘন্য ঘটনার জন্য লুত দায়ী ছিলেন না। কিতাবুল মোকাদ্দসে কখনও বলা হয় নি যে লুত একজন ‘নবী’ ছিলেন বরং তিনি শুধু নবী ইবরাহিম (আঃ) এর ভাইপো ছিলেন।

রূবেণের পাপ (পয়দায়েশ ৩৫:২২) – রূবেণ কোন নবী ছিল না, এবং তার এই জঘন্য পাপের শাস্তি হিসেবে তার প্রথম সন্তানের অধিকার তার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হল (পয়দায়েশ ৪৯:৪)।

এহুদা ও তামর (পয়দায়েশ ৩৮:১৫-১৮, পয়দায়েশ ৩৮:২৭-৩০) – ইহুদি নিয়ম অনুযায়ী সন্তান ছাড়া যদি একজন নারীর স্বামী মারা যান, তার ভাসুর বা স্বামীর ভাই তাকে বিয়ে করবে এবং যে সন্তান হবে তারা সেই মৃত ভাইয়ের সন্তান হিসেবে গণ্য হবে এবং উত্তরাধিকার পাবে। কিন্তু এহুদার বউমা তামরের স্বামী এরের মৃত্যুর পরে এরের ভাই ওনন সেই দায়িত্ব অগ্রাহ্য করলেন। তামর যা করেছে সেটা অবশ্যই খারাপ বাইবেলের শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল (দ্বিতীয় বিবরণ ২৩:১৭), এবং এহুদা যে বেশ্যার সঙ্গে সহবাস করলেন সেটাও খারাপ ও বাইবেলের শিক্ষার বিরুদ্ধে (১ করিন্থীয় ৬:১৫-১৬)।

…মদ্যপ (আদিপুস্তক ৯:২০)…

হযরত নূহের মদ খাওয়া (পয়দায়েশ ৬:২০) – বাইবেলের শিক্ষা হল “মাতাল হয়ো না” (ইফিষীয় ৫:১৮), তাই অবশ্যই হযরত নূহের এই কাজ খারাপ ছিল। এখানে আমরা ধরে নিতে পারি যে হযরত নূহ জানতেন না যে সেই আঙুর রস তাকে মাতাল করবে, কারণ এখানে বলা হয়েছে যে নূহ কেবল তখনই চাষ-আবাদ শিখছিলেন।

মিথ্যাবাদী (যাত্রাপুস্তক ৩:১৭-১৮, যাত্রাপুস্তক ৫:৩, ১১:২, যাত্রাপুস্তক ১২:৩৫; ১ শমূয়েল ১৬:১-৪)

এই আয়াতগুলো আমরা দেখি:

“সেইজন্যই আমি বলছি, মিসরের জুলুম থেকে বের করে আমি তোমাদের কেনানীয়, হিট্টীয়, আমোরীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবূষীয়দের দেশে নিয়ে যাব। সেখানে দুধ, মধু আর কোন কিছুর অভাব নেই।”(হিজরত ৩:১৭-১৮)

“তখন তাঁরা বললেন, “ইবরানীদের আল্লাহ্ আমাদের দেখা দিয়েছেন। তাই আপনি দয়া করে আমাদের যেতে দিন যাতে আমরা মরুভূমিতে তিন দিনের পথ গিয়ে আমাদের মাবুদ আল্লাহর উদ্দেশে পশু-কোরবানী দিতে পারি। তা না হলে তিনি হয়তো কোন মহামারী বা তলোয়ারের মধ্য দিয়ে আমাদের উপর শাস্তি আনবেন।” (হিজরত ৫:৩)

“তুমি বনি-ইসরাইলদের বলবে, স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যেন তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সোনা ও রূপার জিনিস চেয়ে নেয়।” (হিজরত ১১:২)

“বনি-ইসরাইলরা মূসার কথামত মিসরীয়দের কাছ থেকে সোনা-রূপার জিনিস এবং কাপড়-চোপড় চেয়ে নিল।” (হিজরত ১২:৩৫)

সম্ভবত এই সমালোচক দাবি করছে যে আল্লাহ ফেরাউনকে মিথ্যা বলেছে। তিনি মূসার কাছে ফেরাউনকে বলতে বলেছেন যেন তিনি তাদের ‘তিন দিন মরুভূমিতে এবাদত করার জন্য’ অনুমতি চাইলেন, কিন্তু একেবারে কেনান দেশে যাওয়ার কথা ফেরাউনকে বলেন নি। কিন্তু এখানে আমি কোনো মিথ্যা দেখি না। মূসা যদি বলতেন “আমরা তিন দিন এবাদত করার পরে ফিরে আসব তাহলে মিথ্যার অভিযোগ থাকত, কিন্তু ফিরে আসা বা ফিরে না আসার কথা মূসা বলেন নি।

মিথ্যাবাদী … ১ শমূয়েল ১৬:১-৪

এখানে লেখা আছে:

পরে মাবুদ শামুয়েলকে বললেন, “আমি তালুতকে বনি-ইসরাইলদের বাদশাহ্‌ হিসাবে অগ্রাহ্য করেছি, কাজেই তুমি আর কতকাল তার জন্য দুঃখ করবে? এখন তুমি তোমার শিংগায় তেল ভরে নিয়ে বেরিয়ে পড়। আমি তোমাকে বেথেলহেম গ্রামের ইয়াসির কাছে পাঠাচ্ছি। আমি তার ছেলেদের মধ্য থেকে আমার নিজের উদ্দেশ্যে একজনকে বাদশাহ্‌ হবার জন্য বেছে রেখেছি।” শামুয়েল বললেন, “আমি কি করে যাব? তালুত এই কথা শুনলে তো আমাকে মেরে ফেলবে।” মাবুদ বললেন, “তুমি একটা বক্‌না বাছুর তোমার সংগে নিয়ে যাবে এবং বলবে যে, তুমি মাবুদের উদ্দেশে কোরবানী দিতে এসেছ। সেই কোরবানীতে তুমি ইয়াসিকে দাওয়াত করবে। তারপরে তোমাকে যা করতে হবে তা আমি বলে দেব। আমি যার কথা তোমাকে বলব তুমি তাকেই আমার উদ্দেশে অভিষেক করবে।”শামুয়েল মাবুদের কথামতই কাজ করলেন। তিনি যখন বেথেলহেমে উপস্থিত হলেন তখন গ্রামের বৃদ্ধ নেতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর সংগে দেখা করতে আসলেন। তাঁরা জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি শান্তির মনোভাব নিয়ে এসেছেন?” (১ শামুয়েল ১৬:১-৪)

শামুয়েল যদি তালুতকে বলতেন “আমি শুধুমাত্র কোরবানী করব, অন্য কিছু করব না” তাহলে মিথ্যা হত; কিন্তু আল্লাহ তাকে কোরবানী দিতেও বলেছেন এবং শামুয়েল তাই করলেন, তাই এখানে কোনো মিথ্যা নেই। মূসা ও শামুয়েলের এই দুই জায়গায় মিথ্যার অভিযোগ তুললে কোরআনেও:

وَمَكَرُواْ وَمَكَرَ اللّهُ وَاللّهُ خَيْرُ الْمَاكِرِينَ
এবং কাফেরেরা চক্রান্ত করেছে আর আল্লাহও কৌশল অবলম্বন করেছেন। বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কুশলী। (সূরা আলে-ইমরান ৩:৫৪)

এখানে আল্লাহর উপাধি হল المَاكِرِينَ আল-মাকিরীন; যার মূল শব্দ ماكر মাকর অর্থাৎ “চতুর” বা “প্রতারক”। এটা নিয়ে সমস্যা না হলে তাহলে বাইবেলে মূসা ও দাউদের ঘটনাগুলো নিয়ে সমস্যা থাকার কথা না।

তাঁরা মানুষের মল ও গোবিষ্ঠা ভক্ষণ করতেন (যিহিষ্কেল ৪:৪-১৫)

এখানে সমালোচক নিজেই মিথ্যা বলছে – ইহিস্কেল তো মল ও গোবিষ্ঠা খান নি এবং কেউ তাকে সেগুলো খেতে বলেন নি। অবাধ্য জেরুসালেমবাসীদের প্রতি ইহিস্কেরের বাণী ছিল যে ভয়ংকর একটি শাস্তি আসবে। শত্রুরা তাদের শহর ঘিরে দিয়ে ভিতরে এমন অভাব হবে যে রান্নার লাকড়ির জন্য মল ছাড়া কিছু থাকবে না। তাদেরকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যই এই নাপাক উদাহরণ দেখাতে বলেছে আল্লাহ, কিন্তু ইহিস্কেল অভিযোগ করার পরে আল্লাহ তাকে গোবর লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছেন। রান্নার জন্য গোবর লাকড়ি হিসেবে ব্যবহার করা কি এতো অদ্ভুত কিছু?

উলঙ্গ হয়ে চলাফেরা করতেন (যিশাইয় ২০:২-৪),

পুরো অনুচ্ছেদ এমন:

“আশেরিয়া দেশের বাদশাহ্ সগ্রোনের পাঠানো সেনাপতি অস্দোদে এসে তা আক্রমণ করে অধিকার করেছিলেন। যে বছর তিনি আক্রমণ করেছিলেন সেই বছরে মাবুদ আমোজের ছেলে ইশাইয়াকে বলেছিলেন, “তোমার শরীর থেকে ছালার চট ও পা থেকে জুতা খুলে ফেল।” এতে ইশাইয়া উলংগ হয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তারপর মাবুদ বললেন, “আমার গোলাম ইশাইয়া যেমন মিসর ও ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে একটা চিহ্ন ও ভবিষ্যতের লক্ষণ হিসাবে তিন বছর ধরে উলংগ হয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, ঠিক তেমনি করে আশেরিয়ার বাদশাহ্ মিসরকে লজ্জা দেবার জন্য মিসরীয় ও ইথিওপীয় বন্দীদের ছেলে-বুড়ো সবাইকে উলংগ অবস্থায়, খালি পায়ে ও পেছন-খোলা অবস্থায় নিয়ে যাবে। যারা ইথিওপিয়া দেশের উপর ভরসা করেছিল এবং মিসরকে নিয়ে বড়াই করেছিল তারা ভয় পাবে ও লজ্জিত হবে।” (ইশাইয়া ২০:২-৪)

এখানে মূল হিব্রু ভাষায় “উলংগ” (עָר֣וֹם) এই বোঝায় না, যে নবি ইশাইয়া সম্পূর্ণ উলংগ ছিল। বলা হয়েছে তাকে তার বাইরের ছালার চট পোশাক খুলতে, ভিতরের জামা খোলার কথা বলা হয়নি। এই ব্যাপারে বিষেশজ্ঞদের ব্যাখ্যা স্পষ্ট (দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এখানে)। হাদিসে কিন্তু আরও স্পষ্টভাবে নবীদের উলঙ্গ অবস্থা ঘুরাফেরার কথা বলা হয়েছে, যে হযরত মূসা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দৌড় দিচ্ছিলেন সবার সামনে এবং সবাই তার অণ্ডকোষ
দেখেছে (দেখুন বুখারি শরিফেদুই জালালের তফসিরে)। তৌরাত শরিফে এই ঘটনার কথা নেই।

মদপান করে উলঙ্গ হতেন (আদিপুস্তক ৯:২০),

দ্বিতীয়বার আবার হযরত নূহের একই প্রসঙ্গ তুলছে – আমরা উপরে এর উত্তর দিয়েছি।

মূর্তিপূজা করতেন (যাত্রাপুস্তক ৩২:১-৩৫:; ১ রাজাবলি ১১:১-১৩)… …. ইত্যাদি।

বাইবেলে মূসার ভাই হারুনকে কোথাও “আল্লাহর নবী” বলা হয়নি; তিনি মূসার বার্তাবাহক ছিলেন। হযরত মূসা তুর পাহাড় অনেকদিন থাকার পরে বনি-ইসরাইল বিদ্রোহি হয়ে উঠল এবং হারুনকে চাপ দিল তিনি যেন তাদের জন্য মূর্তি বানাই, এবং হারুন তাদের ভয় করে সেটা করেছে তাদের জন্য। কিন্তু কিতাব পরিষ্কারভাবে লেখা আছে যে সেটা আল্লাহর চোখে জঘন্য কাজ ছিল এবং এই মহাপাপের জন্য তিন হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু মূসা তাদের জন্য অনুরোধ করলেন বলে সবাইকে ধ্বংস করা হয়নি।

১ রাজাবলি ১১:১-১৩…

হযরত সোলায়মান তার রাজত্বকালের শুরুতে আল্লাহকে ভয় করত, কিন্তু ধনী হওয়ার পরে তার মন আল্লাহর কাছে সরে গেল:

“সোলায়মানের বুড়ো বয়সে তাঁর স্ত্রীরা তাঁর মন দেব-দেবীদের দিকে টেনে নিয়েছিল। তার ফলে তাঁর বাবা দাউদের মত তাঁর দিল তাঁর মাবুদ আল্লাহর প্রতি ভয়ে পূর্ণ ছিল না।” (১ বাদশাহনামা ১১:৪)

এইসব কাজ মাবুদের চোখে “খারাপ” ছিল (৬ আয়াতে) এবং “মাবুদ সোলায়মানের উপরে রেগে গেলেন” (৯ আয়াতে)। এর শাস্তি হিসেবে আল্লাহ সোলায়মানের কাছ থেকে তার রাজ্য ছিঁড়ে নিয়ে তার একজন কর্মচারীকে দিয়েছেন (১১ আয়াত)।

যে পাপের কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে উঠে এবং যে পাপ করতে পাপীও রাজি হয় না সে পাপও নবীগণ ও তাদের সন্তানগণ করতেন বলে বাইবেলে বলা হয়েছে। যেমন নিজের কন্যাদের সাথে ব্যভিচার করা (আদিপুস্তক ১৯:৩৩-৩৮),

এই ঘটনার ব্যাখ্যা উপরে দেওয়া হয়েছে, তাই আবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

পিতার স্ত্রীকে ধর্ষণ করা (আদিপুস্তক ৩৫:২২),

এই ঘটনার ব্যাখ্যা উপরে দেওয়া হয়েছে, তাই আবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

নিজের বোনকে ধর্ষণ করা (২ শমূয়েল ১৩:১১-১৪),

কিতাবুল মোকাদ্দসে অম্নোনের এই জঘন্য কাজকে অবশ্যই জঘন্য বলা হয়েছে, এবং এর জন্য অম্নোনের শাস্তি হয়েছে।

সকল মানুষের সামনে নিজের পিতার স্ত্রীগণকে গণধর্ষণ করা (২ শমুয়েল ১৬:২২),

অবশালোমের এই জঘন্য কাজের জন্য তাকে মেরে ফেলা হল অল্প দিন পরে।

নিজের পুত্রবধুর সাথে ব্যভিচার করা (আদিপুস্তক ৩৮:১৫-১৮:, আদিপুস্তক ২৭-৩০:) ইত্যাদি

এই ঘটনার ব্যাখ্যা উপরে দেওয়া হয়েছে, তাই আবার দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

এত পাপাচারের পরেও ঈশ্বর তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন নি।

এর মত স্পষ্ট মিথ্যা আর কি হতে পারে? অবশালোমকে পাপের শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে, অম্নোনের পাপের শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে, সোলায়মানের পাপের শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে, ইত্যাদি।

বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে জারজ সন্তানদের প্রতি ঈশ্বরের মায়া মনে হয় একটু বেশিই। ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ ‘দায়ূদ’ এবং ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ ঈসা: দুজনই জারজ সন্তানের বংশধর। (দ্বিতীয় বিবরণ ২:১৭-১৯ এবং দ্বিতীয় বিবরণ ২০:১৩-১৬:, মথি ১:১-৩)।

অন্য একজন সমালোচকের লেখায় আমি এই অভিযোগ পরেছি যে বাইবেলে জারজ সন্তানদের অতিরিক্ত শাস্তি দেওয়া হয়। অতিরিক্ত নাকি বেশি?

ইহূদী-খ্রীষ্টানদের প্রাণপুরুষ দাউদ (আ) দাউদের বংশধর হওয়া যীশুখৃস্টের শ্রেষ্ঠ গৌরব। বাইবেলের ভাষ্যে দায়ূদ ঈশ্বরের প্রথমপুত্র, ঔরসজাত পুত্র ও ঈশ্বরের মাসীহ বা খৃস্ট।

“সদাপ্রভু আমাকে কহিলেন, তুমি আমার পুত্র, অদ্য আমি তোমাকে জন্ম দিয়াছি” (যাবুর ২:৭) “আমার দাস দায়ূদকেই পাইয়াছি, আমার পবিত্র তৈলে তাহাকে অভিষিক্ত করিয়াছি (with my holy oil have I anointed him)।…সে আমাকে ডাকিয়া বলিবে, তুমি আমার পিতা, আমার ঈশ্বর। আবার আমি তাহাকে প্রথমজাত (my firstborn) করিব ..।” (যাবূর ৮৯:২০-২৭)

এ দায়ূদ (আ)-কেও বাইবেলে ব্যভিচারী ও ধর্ষক বলে চিত্রিত করা হয়েছে। উরিয়া নামে দাউদের এক প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধরত ছিলেন। দায়ূদ উরিয়ার স্ত্রীকে এক নজর দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করেন। মহিলা এ ধর্ষণে গর্ভবতী হয়ে যান। দায়ূদ সেনাপতিকে চিঠি লিখে কৌশলে উরিয়াকে হত্যা করান এবং উক্ত মহিলাকে বিবাহ করেন। (২ শমূয়েল ১১:১৪-১৭)

ধর্ষণ ও হত্যা একত্রে! একজন মহাপাপীও এমন করবেন না। একজন পাপী বয়স্ক মানুষ, যার অর্ধশতাধিক স্ত্রী বিদ্যমান, তিনি একজন মহিলাকে একনজর দেখেই তাকে ধর্ষণ করতে ব্যস্ত হবেন এবং তাঁর স্বামীকে হত্যা করবেন?

কোরআনেও এই ঘটনার কথা বলা হয়েছে (৩৮:২১-২৪,৩০)। শীর্ষ ইসলামী তাফসিরবিদ বলেন যে কোরআনে ইউরিয়ার বিরদ্ধে দাউদ যে ঘটনা করেছে সেটার কথা এখানে বলা হয়েছে। যেমন, সূরা ৩৮:২৩-২৪ সম্বন্ধে ইবনে আব্বাস বলেছেন:

(one ewe) i.e. one wife; (and he said: Entrust it to me, and he conquered me in speech) this is a similitude which they struck for David in order for him to understand what he did to Uriah. (Tanwîr al-Miqbâs min Tafsîr Ibn ‘Abbâs; source)

এই ঘটনা অবশ্যই একটি জঘন্য কাজ, কিন্তু হযরত দাউদ আন্তরিক ভাবে তাওবা করেছিলেন, যেটা আমরা জবুর শরিফ ৫১ অধ্যায়ে বিস্তারিত পড়ি। এমন আন্তরিক তাওবার পরেও আল্লাহ তাকে শাস্তি দিয়েছিলেন।

তাওরাতে বিধান ব্যভিচারীকে প্রস্তর নিক্ষেপ করে হত্যা করতে হবে। কিন্তু তাওরাতের ঈশ্বর অপরাধীর চেহারা দেখে বিচার করেন বলে মনে হয়।

পাথর ছুড়ে হত্যা করার শাস্তি দাউদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য য না কারণ শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যতে কাউকে হত্যা করা হবে না বরং শুধু দুই তিন জনের সাক্ষ্যেই ফাঁসি হতে পারে (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:৬), এবং আমরা ধরে নিতে পারি যে দাউদের ক্ষেত্রে ২-৩ জন সাক্ষী ছিল না।

আল্লাহ শুধু দয়াময় নয়, তিনি পরম দয়াময়, পরম দয়ালু। যারা অন্তর কঠিন করে পাপের রাস্তায় যায় তারা আল্লাহর গজব পাবেই, কিন্তু যার মন পরিবর্তন করে সত্যিকার ভাবে তাওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসে, তাদের ক্ষমা করার অধিকার আল্লাহর আছে। কারা সত্যিকার ভাবে তাওবা করেছে এবং কারা করেননি আমরা সেটা বিচার করতে পারি না, কেবল আল্লাহই বুঝতে পারে।

সম্ভবত দায়ূদ যেহেতু ঈশ্বরের পুত্র ও মাসীহ, সেহেতু ঈশ্বর দাউদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিলেন দায়ূদের বৈধ স্ত্রীদেরকে। তিনি দায়ূদকে বলেন, তুমি যেহেতু ব্যভিচার ও হত্যায় লিপ্ত হলে, সেহেতু তোমার সামনে তোমার স্ত্রীদের গণধর্ষণের ব্যবস্থা করব। কী অদ্ভুত বিচার ব্যবস্থা!! একটি পাপের শাস্তি হিসেবে আরেকটি পাপের ব্যবস্থা ও ধর্ষকের শাস্তি হিসেবে নিরপরাধকে ধর্ষণের ব্যবস্থা করা!!

আমাকে যদি কেউ ক্ষতি করে তার থেকে বেশি কষ্ট আমি পাবো যদি আমার ছেলেমেয়ে বা স্ত্রীর ক্ষতি করা হয়। দাউদকে শাস্তি হিসেবে বৈৎশেবার সঙ্গে তার যে প্রথম সন্তান হল সে মারা গেল, এবং দাউদ ভীষণ কষ্ট পেয়েছে কিন্তু সেই সন্তান বেহেশতে গেল (২ শামুয়েল ১২:১৫-২২)।

(২ শমূয়েল ১২:১১-১২) ইঞ্জিলের বর্ণনা অনুসারে ঈসা মাসীহও ভয়ঙ্কর সব পাপ ও অশোভন কর্মে লিপ্ত হতেন।

“ঈসা মাসীহও ভয়ঙ্কর সব পাপ ও অশোভন কর্মে লিপ্ত হতেন”??? রেফারেন্স নাই দিয়ে কি আবল তাবল কথা বলছে। ঈসা মসীহের কোনো পাপের কথা ইঞ্জিলেও পাবেন না, কোরআনেও পাবেন না। মজার বিষয়, ঈসার মধ্যে কোনো
দোষ পাওয়া যায় নি, এইজন্য সমালোচক এখানে একটি মিথ্যা ঢুকাতে হয়েছে।

আমরা “নবীগণের পাপ ও পাপীর শাফাআত” প্রসঙ্গে তা আলোচনা করব।
এরূপ অগণিত স্ববিরোধী এবং অপবিত্র বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে, কিতাবুল মোকাদ্দস পুরোটাই জাল অথবা এর মধ্যে অনেক জালিয়াতি বিদ্যমান। কুরআন দ্বিতীয় বিষয়টিই নিশ্চিত করে।

কোরআনের শীর্ষ তারসিরবিদ একমত যে কোরআন অনুযায়ী আগেকার আসমানি কিতাবের পরিবর্তন হয়নি (এখানে বিস্তারিত দেখুন)।

কুরআন বলে যে, ইহূদী-খ্রীষ্টানগণ তিনভাবে তাওরাত-ইঞ্জিল নষ্ট করে: (ক) ভুলে যাওয়া (মায়িদা ৫:১৩, ১৪ ও ৪১),

সূরা মায়িদা ১৪-১৫ এ কিতাবের আয়াত ভুলে যাওয়ার কথা বলা হয়নি বরং তাদের কাছে যে উপদেশ দেওয়া হল সেটা কিছুটা ভুলে গেছে, এবং আমরা একমত – বনি-ইসরাইল একগুঁয়ে জাতি ছিল এবং আল্লাহর কথা নিয়মিত প্রত্যাখ্যান করল।

(খ) বিকৃত করা (মায়িদা ৫:১৩,১৪ ও ৪১:)

তাফসিরবিদদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটা আয়াতের পরিবর্তন (التَّحْرِيف اللَفْظي আল-তাহ্‌রিফ আল-লাফ্‌জী ) নয় বরং তেলাওয়াত করার সময়ে ভিন্নভাবে পড়া (তাহ্‌রিফ বিল মাহনে)। বিস্তারিত লেখা আছে এখানে

ও (গ) জাল কথা ও বই সংযোজন করা (বাকারা ২:৭৯; আল-ইমরান ৩:৭৮)

বাকারা ৭৮-৭৯ আয়াতে বলা হচ্ছে যে, ইহুদিদের মধ্যে অবস্থিত কিছু “নিরক্ষর” ((أُمِّيُّونَ, আসলে অ-ইহুদি) লোক নিজ হাতে গ্রন্থ লেখে সেটাকে আসমানী কিতাব হিসেবে তুচ্ছ মূল্যে বিক্রি করতেন (বিস্তারিত এখানে পড়ুন)। এখানে তৌরাত-ইঞ্জিল বিকৃতির কথা বলা হচ্ছে না। সূরা আলে ইমরান ৭৮ আয়াতে লিখিত পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি বরং তেলাওয়াত করার সময়ে ভুলভাবে পড়ার কথা বলা হয়েছে।

এ সকল বিকৃতি ও জালিয়াতির পাশাপাশি এগুলির মধ্যে কিছু কিছু ভালকথা বিদ্যমান। তবে সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোনো পথ নেই। এজন্য আল্লাহ কুরআনকে যাচাইয়ের মানদণ্ড করেছেন এবং এগুলির মূল শিক্ষা কুরআনের মধ্যে উদ্ধৃত ও সংরক্ষিত করেছেন। (সূরা মায়িদা ৫:৪৮) আর গত ২০০ বৎসর যাবৎ ইউরোপ-আমেরিকার ইহূদী-খ্রীষ্টান গবেষকগণ এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করেছেন। ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর—-

কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে আমরা শুনতে চাই! নিচের ফর্ম দিয়ে যোগাযোগ করুন:

Enable javascript in your browser if this form does not load.

Comments are closed.