“কিতাবুল মোকাদ্দস কি অবৈজ্ঞানিক নয়?”

“কিতাবুল মোকাদ্দস কি অবৈজ্ঞানিক নয়?”

কিছু কিছু মুসলমান এবং খ্রীষ্টান এই নিয়ে তর্কাতর্কি করে যে কার ধর্মগ্রন্থ আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে বেশী ভাল মিলে। অবশ্য আমরা জানি যে আসমানী কিতাবের লেখক আবার পৃথিবীর স্রষ্টা, তাই সেগুলোর মধ্যে মিল থাকার কথা। কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দস এবং কোরআন উভয় গ্রন্থ নিয়ে কিছু বৈজ্ঞানিক জটিলতা আছে। আসলে নাস্তিক বৈজ্ঞানিকদের কাছে সবচেয়ে কঠিন বিষয়গুলো উভয় কিতাবে আছে—

  1. কোরআন এবং কিতাবুল মোকাদ্দসে অলৌকিক ঘটনার ইতিহাস
  2. হযরত নূহের ৯৫০ বছর বেঁচে থাকা
  3. ঈসা মসীহ্‌র বিনা পিতা জন্ম
  4. ঈসা মসীহ্‌ মৃতদের জীবিত করে তোলা
  5. ঈসা মসীহ্‌ জন্মান্ধদের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেওয়া
  6. ছয় দিনে পৃথিবীর সৃষ্টি

যারা সৎ ঈমানদার তারা এই জটিলতাগুলো অস্বীকার করে না কিন্তু নম্রভাবে যুক্তিসঙ্গত উত্তর খঁজে, এবং সেই উত্তরগুলো খুঁজে পাওয়া যায়। এই লেখাগুলোতে কিতাবুল মোকাদ্দসের উপর সমালোচকদের এক একটা আপত্তির উত্তর দেওয়া হয়।

বিজ্ঞান এবং ঈমানের সম্পর্ক নিয়ে আরও পড়তে চাইলে “বুকাইলিবাদ পেরিয়ে: বিজ্ঞান, কিতাব ও ঈমান” বইটি সংগ্রহ করুন।

“ঈসা মসীহ্‌কে কেন ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলা হয়?”

“ঈসা মসীহ্‌কে কেন ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ বলা হয়?”

value=”http://www.youtube.com/v/LZV5IqsMWUE?version=3&autohide=1&rel=0″> type=”application/x-shockwave-flash”wmode=”transparent”allowscriptaccess=”always”width=”100%”>

উদাহরণস্বরূপ কোন এক সময়ে ইসলামের অনুসারীদের এক অংশের মধ্যে বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল যে, আল্লাহ্‌তা’আলার দেহ বা হাত পা ছিল। তারা বিশ্বাস করত, আল্লাহ্‌ ছিল হাত, মুখ ইত্যাদি দৈহিক অঙ্গপ্রতঙ্গ ধারণকারী। কোরআন ও হাদিসের অংশ বিশেষের আক্ষরিক বর্ণনার ফলে, এই বিশ্বাসকে প্রমাণ করে তুলেছেন। যেমন ইসলামী দর্শনে লেখা আছে

“এদের (যাহারিয়া ও মুশাব্বিহা) মতে, আল্লাহ্‌ শরীরী, আপন আসনে আসীন। তাঁর হাত মুখ আছে। তিনি রসুল করীমের পবিত্র স্কন্ধে হাত রাখেন এবং রসুল করীমও তার হাতের স্নিগ্ধতা অনুভব করেন।”

পরবর্তীতে অবশ্যই ইসলামী চিন্তাবিদ ও পণ্ডিতরা উপলব্ধি করেছিলেন যে, আক্ষরিক দৃষ্টিকোণে ঐ সব অংশের ব্যাখ্যা দেয়া বা গ্রহণ করা যাবে না। ঐ সব অংশকে সব সময় অলংকারিক রূপক অর্থে গণ্য করতে হবে।

রূপক ব্যাখ্যা

এক সময়ে এটা বুঝতে পারা গেল যে, ধর্মগ্রন্থের কোন কোন অংশকে রূপকভাব অবশ্যই গণ্য করতে হবে। এর পরে কীভাবে অন্যান্য কঠিন অংশগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। যেমন নিম্নলিখিত হাদিসগুলো আক্ষরিক অর্থে বুঝতে খুবই কষ্টকর ছিল। রসুল করিম বলেছিলেন:

“কালো পাথর (হাজরে আসওয়াদ) হলো আল্লাহ্‌র হাত।”

“মুসলমানের অন্তর আল্লাহ্‌র আঙ্গুলসমূহের মধ্যে অবস্থিত।”

“আমি ইয়ামেন থেকে আল্লাহ্‌র খোশবু পাচ্ছি”

এখানে অপ্রত্যক্ষ এবং রূপক ব্যাখ্যা গ্রহণ করায় সমস্ত অসুবিধাগুলো দূরীভূত হয়েছে এবং প্রকৃত অর্থ স্পষ্টরূপে ভেসে উঠেছে।

আগেকার ভুল বুঝাবুঝি

উক্ত প্রকৃতির ধর্মীয় ভুল বুঝাবুঝি শুধুমাত্র কোরআন এবং হাদিসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তৌরাত, জবুর এবং ইঞ্জিলের মধ্যেও এমন বহু ব্যাখ্যার জটিলতা আছে। যেমন, নবিদের উপাধিগুলো নিয়ে সহজেই ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করা সম্ভব।

ইবরাহিম খলিলুল্লাহ্‌

উদাহরণস্বরূপ আমরা হযরত ইবরাহিম (আঃ) সম্বন্ধে একটু চিন্তা করতে পারি। তাঁকে উপাধিটা দেয়া হয়েছিল ‘খলিলুল্লাহ্‌’ বা ‘আল্লাহ্‌র দোস্ত’। এখানে যারা আক্ষরিক অর্থ উপাধিটা বুঝতে চায়, তাদের অনেক জটিলতা ও সমস্যা রয়েছে। কারণ মানুষের দোস্ত থাকতে পারে, কিন্তু আল্লাহ্‌র দোস্ত থাকা কেমন করে সম্ভব?…

‘বিরোধসমূহ’ বুঝা

বিখ্যাত বাইবেল বিশেষজ্ঞ ড. গ্লীসোন আর্চার (পিএইচডি হার্ভার্ড) তাঁর সারা জীবনের কিতাবুল মোকাদ্দস অধ্যয়নের বিষয়টি নিম্নোক্ত ভাবে সংক্ষেপ করেছেন:

হার্ভার্ডের একজন আন্ডার গ্রাজুয়েট ছাত্র হিসাবে এপোলোজেটিকস ও পাককিতাবীয় প্রমাণাদির দ্বারা আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম; আর তাই আমি পাককিতাবীয় ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক জ্ঞান অর্জনের জন্য পরিশ্রম করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ে আমি গ্রিক, ল্যাটিন ও সেইসঙ্গে ফরাসি ও জার্মান ভাষাতেও প্রশিক্ষণ নিলাম। সেমিনারিতে আমার প্রধান বিষয় ছিল হিব্রু, অরামীয় ও আরবি; আর স্নাতোকোত্তর বছরগুলিতে আমি সিরীয় ও অক্কাদীয় ভাষা এবং এই প্রত্যেকটি বিষয়গুলির উপর নৈর্বাচনিক পাঠের শিক্ষাদানের সঙ্গেও যুক্ত হলাম। আগে, হাইস্কুলে আমার শেষ দুই বছরে মধ্যরাজ্য মিসরীয় স্টাডিস বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ দেখা দিয়েছিল এবং পরে এই ক্ষেত্রে শিক্ষা দেওয়ার সময় এই আগ্রহ আরো বেড়ে গিয়েছিল। শিকাগোর ওরিয়েন্টাল ইসস্টিটিউটে আমি অষ্টাদশ শতকের রাজবংশীয় ঐতিহাসিক দলিলপত্র সম্বন্ধে বিশেষ অধ্যয়ন করি এবং সেইসঙ্গে কপ্টিক ও সুমেরীয় ভাষাগুলোও অধ্যয়ন করি। প্রাচীন ভাষায় এই অধ্যয়ন কাজের সঙ্গে আমি ল’-স্কুলের একটি পূর্ণ কোর্সের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম, এবং তার পর ১৯৩৯ সালে ম্যাসাচুসেট্স বার-এ ভর্তি হই। এতে আমি আইনী সাক্ষ্য-প্রমাণের ক্ষেত্রে একটি সামগ্রিক ভিত্তি লাভ করি।

আমি একের পর এক আপাত এই অসঙ্গতিগুলি নিয়ে কাজ করে এবং বাইবেলের তথ্যাদি ও ভাষিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, বা বৈজ্ঞানিক তথাকথিত অসঙ্গতি সম্বন্ধে গবেষণা করে দেখেছি, পাক-কিতাবের নির্ভরযোগ্যতার উপর আমার আস্থা শুধু বাড়তে থাকে। এই-ও পাই, যে পাক-কিতাবের বিরুদ্ধে মানব জাতির প্রতিটি অসঙ্গতির অভিযোগ স্বয়ং পাককিতাবীয় কথা অথবা বস্তুনিষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য দিয়ে পুরোপুরি সমাধান করা হয়েছে। তার দ্বারা পাককিতাব সম্বন্ধে আমার আস্থা ও বিশ্বাস বারবার নিশ্চিত ও দৃঢ় হয়েছে। প্রাচীন মিশরীয়, সুমেরীয়, বা অক্কাদীয় দলীল থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সবই কিতাবুল মোকাদ্দসের তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ; আর তাই নাস্তিক বা সমালোচকদের বিদ্বেষমূলক যুক্তি বা দন্দ্বাহ্বান (চ্যালেঞ্জ) থেকে প্রশিক্ষিত বাইবেলের শিক্ষার্থীর কোন ভয় পাওয়া উচিত না।
এই বইয়ের পিছন দিকে এই উৎসগুলির একটি পূর্ণ তালিকা দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ের উপর আরো বিস্তারিত আলোচনার জন্য শেষ দিকে সহায়ক গ্রন্থাবলীর একটি তালিকাও দেয়া হয়েছে।

পাককিতাব সম্পর্কিত সমালোচকদের ভুল ব্যাখ্যাগুলি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায়:

মূল ভাষাগুলি অগ্রাহ্য করা- আমি এই পর্যন্ত একজন-ও মুসলমান বাইবেল-সমালোচককে পাই নি যিনি বাইবেলের মূল ভাষাগুলি (হিব্রু ও গ্রিক) ভালভাবে পড়তে জানেন, যদিও বিশ্বে লক্ষ লক্ষ বাইবেল শিক্ষার্থী সেগুলি পড়তে জানেন। তাদের বিরোধগুলি প্রায়ই ইংরেজি শব্দের অর্থভিত্তিক, যেমন এরা দাবি করেন যে יום এর অর্থ কেবল ‘দিন’, অথবা ארץ এর অর্থ কেবল গোলক (গেস্নাব), অথবা גּרה עלה এর অর্থ কেবল rumination (জাবর কাটা) কিন্তু refection নয়।

পাককিতাবের সঙ্গে অপরিচিতি- যারা পুরো বাইবেলটি পড়েন নি কেবল তাদের কাছেই অনেক অসঙ্গতি দেখা দেয়। আমি একজন আগ্রহী বাইবেল-সমালোচকের সঙ্গে আলাপ করেছি যিনি যথেষ্ট পরিশ্রম করে পাককিতাব সম্পর্কিত অনেক অসঙ্গতি মুখস্থ করেছেন, কিন্তু তিনি স্বীকার করলেন যে তিনি বাইবেল বা কোরআন কখনও পড়েন নি।

কথিত “অসঙ্গতিসমূহ” যেগুলো কোরআন ও হাদিসেও দেখা যায়- সমালোচকরা যখন নবীদের ৯৫০-বছর বয়সের বর্ণনা, ২৪-ঘণ্টার সৃষ্টির দিনগুলি, ইউসার পক্ষে সূর্যের “স্থির হয়ে দাঁড়ানো’, অথবা আলোর আগেই গাছ-পালার সৃষ্টি বিষয়ে বাইবেলকে আক্রমণ করে, এরা ভুলে যায় যে এইসব বর্ণনা কোরআন শরীফ ও সহীহ হাদিসেও আছে।

অস্বীকৃত অনুলেখকের ভ্রম থেকে যুক্তি দেখানো- ঐতিহাসিক তথ্যাদিতে পাওয়া যায় যে, কোরআন শরীফ ও কিতাবুল মোকাদ্দস উভয় গ্রন্থেরই কিছু পাণ্ডুলিপিতে কপি করার সময় কিছু কিছু ছোট-খাঁটো ভুল হয়েছে, এবং তার পরিমাণ সমগ্র গ্রন্থের ১% এরও কম। এগুলি চিহ্নিত ও দূরীকরণের জন্য একটি বিশেষ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে, যার নাম textual criticism। বিশেষ করে সাংখ্যিক অসাঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে, যে সংখ্যাগুলি দীর্ঘদিন ধরে অনুলেখকের ভ্রম বলে প্রমাণীত বলে চলে আসছে সমালোচকরা সেগুলি অনুলিপিকারদের ভ্রমগুলি থেকে ব্যবহার করে থাকেন। এই ধরনের অনুলেখকের ভ্রম সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানার জন্য অনুলিপিকারদের ভ্রম প্রবন্ধটি দেখুন।

ভ্রমপ্রবণ মানুষের উদ্ধৃতিকে খোদায়ী উক্তি হিসাবে ভুলভাবে পড়া- বাইবেল ও কোরআন উভয় কিতাবেই অন্য মানুষের উক্তি দেয় যার মধ্যে মিথ্যা থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, “উজায়ের হচ্ছেন আল্লাহ্‌র পুত্র”, কিন্তু এটি নিতান্তই একটি উদ্ধৃতিমাত্র। বাইবেলের সমালোচকরা প্রায়ই এই ধরণের উদ্ধৃতি (যেমন নহিমীয়, আইয়ুব, ও হান্নার কথা) তোলে ভুলভাবে ব্যবহার করেন।

অপরিণত বিচার- কেপলার যখন তাঁর প্রকৃতি বিষয়ক অধ্যয়নে একটি আপাত অসঙ্গতি দেখতেন তখন তিনি প্রকৃতির নিয়ম বাদ দিতেন না; তিনি প্রকৃতির উপর আস্থা রাখতেন। কয়েক দশক আগেও বিজ্ঞানীরা বলতেন যে, মৌমাছি (bumble bee) এর পক্ষে ওড়া অসম্ভব হবে; কিন্তু তারা তখন একসঙ্গে পদার্থবিদ্যাকে ত্যাগ করেন নি, তারা বরং স্বীকার করেন যে, উত্তরটি তাদের জানা নেই , এবং পদার্থ বিদ্যার উপর তাদের বিশ্বাস অব্যাহত রেখেছিলেন।

ব্যাপকতর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া বা লুকিয়ে রাখা – এটা সমালোচকদের একটা প্রচলিত উপায়- তাদের মতামতের বিপরীতে নিরানব্বইটি অনুচ্ছেদ অবহেলা করে তারা বাছাইকরা দু’একটি আয়াতের ভুলব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদের ভ্রান্ত ধারণাটি উপস্থাপন করেন।

ইচ্ছাকৃত মিথ্যা- সমালোচকরা যেভাবে বলেছেন, সেভাবে কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য বলবে না যে, বাইবেলের বিপক্ষে পিঁপড়াদের ‘শাসনকর্তা’ বা ‘প্রধানকর্মী’ (foreman) আছে।

বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দেখুন:

<?…

বিজ্ঞান, কিতাব ও বিশ্বাস

আল্লাহ্‌র কালাম ও বিজ্ঞানের যথার্থ সম্পর্ক

সূচিপত্র:

প্রথম খণ্ড : বুকাইলিবাদের পরিচয়

বুকাইলিবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর ধারণা

বুকাইলিবাদের সমস্যাগুলি

বুকাইলিবাদের ইতিহাস

বেদ ও অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রে “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়”

কিছু “বৈজ্ঞানিক বিস্ময়’-এর বিশ্লেষণ

-বৈজ্ঞানিক বিস্ময় #১ : চাঁদের প্রতিফলিত আলো

-বৈজ্ঞানিক বিস্ময় # ২ : মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পর্যায়সমূহ

-বৈজ্ঞানিক বিস্ময় # ৩ : পিপড়াদের মধ্যে যোগাযোগ

দ্বিতীয় খণ্ড : কিতাব ও বিজ্ঞানের সমন্বয়

সৃষ্টি ও বিজ্ঞান

তৌরাতে সৃষ্টির ধাপগুলো

সূর্যের পূর্বে উদ্ভিদজগত সৃষ্টি?