১ জোড়া নাকি সাত?

পয়দায়েশ ৬:১৯-২০—“জাহাজে কি হযরত নূহের প্রতিটি প্রাণীর ১ জোড়া (পয়দায়েশ ৬:১৯-২০) আনার কথা ছিল নাকি সাত জোড়া (পয়দায়েশ ৭:২ এবং ৭:৮,৯) আনার কথা ছিল?”

এটা সহজ – পয়দায়েশ ৭ অধ্যায়ে বলা হয়েছে যে প্রতিটি ‘পাক’ প্রাণীর সাত জোড়া আনাতে হয়, কিন্তু পয়দায়েশ ৬ অধ্যায়ে অন্যান্য প্রাণীর জন্য একটা করে জোড়া আনার কথা বলা হচ্ছিল। পয়দায়েশ ৭:২ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যেন ‘পাক’ প্রাণীগুলো সাত জোড়া করে এবং নাপাক প্রাণীগুলো এক জোড়া করে জাহাজে আনা হয়। অবশ্যই এখানে কোন অমিল নেই।

সাত জোড়া করে পাক প্রাণীগুলো আনার উদ্দেশ্য স্পষ্ট; মহাবন্যার পরে হযরত নূহ্‌ কোরবানী দিয়েছিলেন এবং শুধু এক জোড়া থাকলে পাক প্রাণীগুলো বিলুপ্ত হয়ে যেত। কিন্তু নাপাক প্রাণী যেহেতু কোরবানী করা হয় না সেহেতু একটা নিলে যথেষ্ট হত।

জাহাজে প্রতিটি প্রজাতি?

পয়দায়েশ ৬:১৯—“হযরত নূহের জাহাজে প্রত্যেকটি জাতি প্রাণী ঢোকানো সম্বব না, কারণ বিশ্বে লক্ষ লক্ষ প্রজাতি আছে”

সমালোচকদের মনে করিয়ে দেওয়া উচিত যে কোরআন শরীফেও একই বর্ণনা পাওয়া যায় যে জাহাজে প্রতিটি প্রজাতি ছিল:

“অতঃপর আমি তাহার নিকট ওহী পাঠাইলাম, ‘তুমি আমার তত্ত্বাবধানে ও আমার ওহী অনুযায়ী নৌযান নির্মাণ কর, অতঃপর যখন আমার আদেশ আসিবে ও উনুন উথলিয়া উঠিবে তখন উঠাইয়া লইও প্রত্যেক জীবের এক এক জোড়া এবং তোমার পরিবার-পরিজনকে …” (সূরা মু’মিনূন ২৩:২৭)

লক্ষ লক্ষ প্রজাতি আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশই সমুদ্রে থাকে যাদের নৌকা ওঠার প্রয়োজন নেই। আবারও ডাঙার প্রাণীর মধ্যে শুধুমাত্র প্রধান ২৯০টা প্রজাতি ভেড়া থেকে বড়; অধিকাংশই ছোটখাট কীট বা পোকা। একজন তওরাত বিশেষজ্ঞ লিখেছেন—

জাহাজের মাপ স্থিতি এবং বহন-ক্ষমতার জন্য উত্তম ছিল। Hydrodynamic-ভাবে প্রমাণ করা হয়েছে যে ঐ মাপে সেটা উলটানো প্রায় অসম্ভব এবং বাইরে যত ঝড়তুফান হত ভিতরে মোটামুটি আরাম থাকত। প্রাচীন ‘ক্যুবিত’ মাপের জন্য আমরা যদি ন্যূনতম অনুমান ১৭.৫ ইঞ্চি ব্যবহার করি তাহলে জাহাজের মধ্যে ১২৫ হাজার ভেড়ার মত বড় প্রাণীর জন্য জায়গা হত। যেহেতু ডাঙার প্রাণীর মধ্যে (পাখি,সরীসৃপ, স্তন্যপ্রায়ী এবং উভচর প্রাণী) বিদ্যামান এবং লুপ্ত সর্বচ্চ ২৫,০০০ প্রজাতি আছে, এবং যেহেতু সেগুলো গড়ে ভেড়ার অনেক ছোট, সেহেতু খুব সহজেই সবগুলো নূহের জাহাজে ঢোকানো যেত, প্রাতিটি জোড়া আলাদা কক্ষে।

…প্রাণীগুলো অবশ্য কম বয়সি ছিল যেহেতু এরা জাহাজে এক বছর ধরে সেগুলো বংশবৃদ্ধি করে নি এবং মহাবন্যার পরে দুনিয়াতে আবার বংশবৃদ্ধি করল … যেসব প্রাণী জাহাজে ঢুকল সেগুলো হয়ত জাহাজের মধ্যে সারা বছর অচেতন অবস্থায় কাটাল।

আবার মহাবন্যা যদি কেবলমাত্র আঞ্চলিক হত (পয়দায়েশ ৭ অধ্যায় নিয়ে নিচের আলোচনা দেখুন), তাহলে হয়ত শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক প্রাণীগুলো জাহাজের ভিতরে ছিল।

সৃষ্টি-৬০০০ বছর আগে?

পয়দায়েশ ৫—“বংশতালিকার বছর যোগ করলে হিসাব করা যায় যে হযরত আদম এবং বিবি হাওয়া (আঃ) মাত্র ছয় হাজার বছর আগে বেঁচে ছিল যেটা অসম্ভব”

তওরাত শরীফের বংশতালিকার উপর বর্তমানের ব্যাখ্যা চাপিয়ে দিলে, হযরত আদম এবং বিবি হাওয়া (আঃ) সৃষ্টি হয়েছে মাত্র চার হাজার বছর খ্রীষ্টপূর্ব আগে এবং হযরত নূহ্ ছিল মাত্র ২,১০০ বছর খ্রীষ্টপূর্ব। কিন্তু প্রতিটি আসল তওরাত বিশেষজ্ঞ যেমন জানে, এটা তওরাত শরীফের ভুলব্যাখ্যা হত, কারণ হিব্রু বংশতালিকার নিয়ম অনুযায়ী স্বাধীনভাবে বংশ বাদ দেওয়া যায়। এইজন্য ঈসা মসীহ্কে হিব্রু হিসাবে বলা যায় “দাউদের সন্তান” এবং দাউদ “ইবরাহিমের সন্তান” (মথি ১)। মূলত হিব্রু বংশতালিকার উদ্দেশ্য সময়ের হিসাব নয় বরং বংশের সূত্র দেওয়া। কিতাবুল মোকাদ্দসে কখনও এইভাবে বংশতালিকার বছর যোগ করে হযরত আদম (আঃ) বা হযরত নূহ্ (আঃ) এর তারিখ গণনা করা হয় না।

হিব্রু বংশতালিকার নিয়মে হযরত ঈসা মসীহ্‌র বংশতালিকা লিখলে এইভাবে লেখা যায় :

“এবং ইবরাহিম বয়স যখন ১০০ বছর ছিল তখন তিনি দাউদের পিতা হন (অর্থাৎ ১০০ বছর বয়সে তার সন্তান হল যার বংশে দাউদের জন্ম হল)
এবং দাউদের বয়স যখন ৪০ বছর ছিল তখন তিনি ঈসা মসীহ্‌র পিতা হন (অর্থাৎ ৪০ বছর বয়সে তার সন্তান সোলায়মানের জন্ম হল যার বংশে ঈসা মসীহ্‌র জন্ম হল)

হয়ত প্রশ্ন আসবে যে, তাহলে কেন এইসব বয়সের সংখ্যা দেওয়া হল?…

কাবিলের ‘ভবিষ্যদ্বানী’ ভুল?

পয়দায়েশ ৪:১২-১৬—“এখানে একটি ভুল ভবিষ্যদ্বানী আছে, কারণ ১২ আয়াতে বলা হয়েছে যে কাবিল পলাতক হয়ে দুনিয়াতে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু ১৬ আয়াতে বলা হয় যে তিনি নোদ নামে একটা দেশে বাস করতে লাগল।”

ভবিষ্যদ্বানী দুটা কথা বলেছে – যে তার আপন দেশ থেকে কাবিল নির্বাসিত হবে এবং যে তিনি একজন נוּע (ফেরারী) এবং נוּד (মুসাফির) হবে। হিব্রুতে এই দুই শব্দ ‘ফেরারী’ এবং ‘মুসাফির’ মূলত বোঝায় যে তাঁকে হত্যা করার জন্য মানুষ তাকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু ১২ এবং ১৬ আয়াতের মধ্যে লক্ষ্য করতে হবে যে আল্লাহ্‌ তার শাস্তি কমিয়ে দিয়েছেন যখন কাবিল হতাশ হয়ে গেল। আল্লাহ্‌র রহমতে তিনি বলেছেন যে, হ্যাঁ, তিনি নির্বাসিত হবে, কিন্তু

মালোচনা করেছে, তিনি হয়ত জানে না যে কোরআন শরীফও এই প্রথম মানুষদের লম্বা আয়ু সমর্থন করে:

“আমি তো নূহ্‌কে তাহার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করিয়াছিলাম। সে উহাদের মধ্যে অবস্থান করিয়াছিল পঞ্চাশ কম হাজার বছর।” (সূরা আনকাবূত ২৯:১৪)

তওরাত শরীফেও বলা হয় যে হযরত নূহ (আঃ) এর বয়স ছিল ৯৫০ বছর।

সাপ তো ধুলা খায় না

পয়দায়েশ ৩:১৪—“সাপ তো ধুলা খায় না”

অবশ্যই সাপ ধুলা খায় না, যদিও গন্ধ নেয়ার জন্য এরা মুখে ও জিভে বাতাসের ধুলা নেয়। কিন্তু হিব্রু ভাষায় “ধুলা খাওয়া” বা “পায়ের ধুলা চাটা” (হিব্রুতে עפר תאכל এবং לחכו עפר ) শুধু লজ্জা এবং পরাজয় বোঝানোর একটি বাগধারা:

“মরুভূমির লোকেরা তাঁর কাছে নত হোক আর তাঁর শত্রু রা তাঁকে পায়ে ধরে সালাম করুক।” (জবুর ৭২:৯)

“বাদশাহ্‌রা … মাটিতে উবুড় হয়ে তোমাকে সম্মান দেখাবে আর তোমার পায়ের ধুলা চাটবে।” (ইশাইয়া ৪৯:২৩)

সাপ যে ‘ধুলা খাবে’ সেটার প্রকৃত অর্থ হল যে আল্লাহ্‌ তাকে ছোট করেছে এবং পরাজিত করেছে।

বিষাক্ত গাছ?

পয়দায়েশ ২:১৬-১৭—“এখানে বলা হচ্ছে সব গাছ পালা খাওয়া যায়, কিন্তু কিছু কিছু গাছ বিষাক্ত”

যখন কিতাবে হালাল-হারামের বিধান দেয়া হয় যে শূকর, মরা জন্তু, রক্ত এবং মদ ছাড়া সবকিছু খাওয়া যায়, শুধুমাত্র যাদের সাধারণ জ্ঞানের খুব অভাব আছে তারা তাতে বিষাক্ত গাছ ও মাংস এড়িয়ে যাবে না। যখন আল্লাহ্‌পাক হযরত আদম (আঃ)-কে প্রতিটি গাছের ফল খেতে অনুমতি দিন, তিনি তাতে সবকিছু খাওয়ার হুকুম দিচ্ছেন না বরং শুধু তাঁকে স্বাধীনতা দিচ্ছেন।

এই আয়াত একটু বিশ্লেষণ করলে দুটি জিনিস দেখা যায়। প্রথমত ‘যে কোন গাছ’ অবশ্য প্রত্যেকটি গাছ বোঝাচ্ছে না কারণ শেষে বলা হয়েছে যে অন্তত একটা গাছের ফল নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে ‘এই বাগানের যে কোন গাছের ফল’। হয়ত ঐ বাগানে কোন বিষাক্ত গাছ ছিল না, আবার হয়ত দুনিয়াতে পাপ ঢোকার আগে বিষাক্ত গাছ ছিল না। পয়দায়েশ ৩:১৭-১৮ আয়াতের শিক্ষা অনুযায়ী, হযরত আদমের অবাধ্যতার ফলে মাটি এবং গাছপালা একটু পরিবর্তিত হল এবং মানুষের জন্য আরও কষ্টকর হয়ে গেল।

কোরআন শরীফের ক্ষেত্রেও আয়াতগুলো অত আক্ষরিক ভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না। সূরা যারিয়াতে লেখা আছে:

“আর প্রত্যেক বস্তু আমি সৃষ্টি করিয়াছি জোড়ায় জোড়ায়, যাহাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” (সূরা যারিয়াতে ৫১:৪৯)

কিন্তু কিছু কিছু প্রাণী আছে যেগুলোর স্ত্রী-পুরুষ লিঙ্গ নেই, যেমন নিউ মেক্সিকো ওয়িপ্‌টেইল লিজার্ডের (Cnemidophorus neomexicanus ) মত বেশ কিছু লিজার্ড প্রজাতি শুধু স্ত্রীলিঙ্গে হয় এবং নিজে নিজে গর্ভোৎপাদন করে ডিম পারে। আবার আধুনিক বিজ্ঞান অনুযায়ী একটি খুব ব্যাপক ছাতলা প্রজাতি আছে ( Schizophyllum commune ) যার অনেক বেশী লিঙ্গ আছে। এতে আমি কোরআনের সমালোচনা করছি না বরং শুধু দেখাচ্ছি যে কিতাব সবসময় আক্ষরিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

আল্লাহ্‌র বিশ্রাম

পয়দায়েশ ২:২-৩—“আল্লাহ্‌র কোন বিশ্রাম করার দরকার নাই কারণ তার কোন ক্লান্তি নাই (সূরা ক্বাফ ৫০:৩৮)”

কিতাবুল মোকাদ্দসও কোরআনের মতো একই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ্‌র কোন ক্লান্তি নেই বা বিশ্রামের প্রয়োজন নেই—

“যিনি তোমাকে পাহারা দেন তিনি ঘুমে ঢুলে পড়বেন না।
যিনি বনি-ইসরাইলদের পাহারা দেন তিনি তো ঘুমে ঢুলে পড়েন না, ঘুমানও না।”
(জবুর শরীফ ১২১:৩-৪)

“মাবুদ, যিনি চিরকাল স্থায়ী আল্লাহ্, যিনি দুনিয়ার শেষ সীমার সৃষ্টিকর্তা,
তিনি দুর্বল হন না, ক্লান্তও হন না; তাঁর বুদ্ধির গভীরতা কেউ মাপতে পারে না।”
(ইশাইয়া ৪০:২৮)

সৃষ্টির ছয় দিনের শেষে আল্লাহ্‌র বিশ্রাম করার কোন দরকার ছিল না, তাও তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবে তার সৃষ্টি কাজ থেকে এক দিন বিরত থাকলেন। হিব্রু শব্দ ‘বিশ্রাম’ এর আরেকটি অভিধানিক অর্থ ‘বিরতি’ বা ‘থেমে যাওয়া’। শুধু কিতাবুল মোকাদ্দস নয় বরং কোরআন শরীফেও আল্লাহ্‌র ক্ষেত্রে মনুষ্য ভাষা ব্যবহার করা হয় যেমন তার ‘মুখ’ (وجه সূরা রাহ্‌মান ৫৫:২৬), তার ‘হাত’ (يد সূরা ফাত্‌হ্‌ ৪৮:১০), তার ‘চোখ’ (عَيْنِي সূরা তা-হা ২০:৩৬-৩৯), তার ‘সিংহাসন’ (الْعَرْشِ সূরা হাদীদ ৫৭:৪); তিনি ‘ভুলে যান’ (ننسى সূরা আ’রাফ ৭:৫১)। তার মানে এই না যে আল্লাহ্‌ মানুষের মতো, বরং আল্লাহ্‌ আমাদের সীমিত মনুষ্য ভাষা ব্যবহার করেন যেন আমরা তাকে একটু বুঝতে পারি।

চাঁদের আলো প্রতিফলিত নয়?

পয়দায়েশ ১:১৪-১৯—“এখানে বলা হচ্ছে যে চাঁদ একটি আলো, কিন্তু আসলে সেটা আলো না বরং শুধু সূর্যের প্রতিফলিত আলো”

Common Objections to the Bible

পয়দায়েশ ১:১৪-১৯—“এখানে বলা হচ্ছে যে চাঁদ একটি আলো, কিন্তু আসলে সেটা আলো না বরং শুধু সূর্যের প্রতিফলিত আলো”

এই যুক্তি অত্যন্ত দুর্বল, কারণ একই যুক্তি অনুযায়ী ‘moonlight’ বলা যাবে না, কারণ সেটাও ‘মিথ্যা’ হবে। সৃষ্টি বর্ণনা করার জন্য সকল ধর্মগ্রন্থ তো এমন phenomenological পরিভাষা ব্যবহার করে, অর্থাৎ আমাদের প্রত্যক্ষ ইন্দ্রিয়ের অবধারণার দৃষ্টি থেকে বলা হচ্ছ – কোরআন শরীফেও চাঁদকে ‘আলো’ (نُور নূর ) বলা হয় (সূরা নূহ্‌ ৭১:১৫-১৬)। হিব্রু শব্দ “আলো” ( মাওর) দিয়ে বোঝানো হয় সরাসরি আলো এবং প্রতিফলিত আলো (যেমন মেশাল ১৫:৩০ আয়াতে)। কিতাবুল মোকাদ্দসের কিছু কিছু আয়াতে ইঙ্গিত আছে যে চাঁদের আলো সূর্যের আলোর উপর নির্ভর করে (ইহিষ্কেল ৩২:৭-৮; মথি ২৪:২৯)।

কোরআন শরীফে আবার চাঁদ নিয়ে একটি জটিলতা আছে, কারণ সূরা নূহে বলা হয়েছে যে আসমানের সাতটা স্তর আছে এবং সবচেয়ে কাছাকাছি স্তরে তারাগুলো আছে (৪১:১২) কিন্তু চাঁদ হচ্ছে তারার চেয়ে আরও দূরে অবস্থিত, মাধ্যম স্তরেই (সূরা নূহ্‌ ৭১:১৫,১৬)। অর্থাৎ কিতাবুল মোকাদ্দসের চাঁদ বর্ণনা আক্রমন করতে গিয়ে একই মাপকাঠিতে কোরআন শরীফও আক্রমন করা হয়।

সৃষ্টির ধাপের ক্রম

পয়দায়েশ ১:১১-১৩–“দিন-রাত সৃষ্টি হওয়ার আগে কীভাবে সূর্য-চন্দ্র থাকতে পারে?”

 

পয়দায়েশের দিনগুলোর ক্রম

সমালোচকগণ দুনিয়া সৃষ্টির পর্যায়ক্রমকে চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে, কীভাবে সূর্য সৃষ্টির আগেই ‘রাত-দিন’ হতে পারে, অথবা কীভাবে সূর্য সৃষ্টির আগেই গাছ-পালা পৃথিবীতে জন্মাতে পারে। পয়দায়েশের ধাপগুলোর নিম্নের ব্যাখ্যা এসব ভুল ধারণাগুলোকে দূর করে।

মূলতঃ পয়দায়েশের প্রথম আয়াত যে দৃষ্টিকোণ স্থাপন করেছে তা হল পৃথিবীর পানির তল থেকে, যেখানে সৃষ্টির শেষে মানুষকে রাখা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টির সব ধাপগুলো বর্ণনা করা হয় পয়দায়েশের প্রথম অধ্যায়ে, কোনো কাল্পনিক দূর মহাকাশে অবস্থিত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। সঠিক দৃষ্টিকোণ বা দেখার অবস্থান পেলে সৃষ্টির ধাপগুলোর ক্রম নিয়ে অনেক ভুলধারণা দূর হয়ে যায়:

বর্তমান বৈজ্ঞানিক তথ্য :

পয়দায়েশের বর্ণনা :

সৃষ্টির শুরু (১৪০০ কোটি বছর আগে)
বিগ ব্যাংগ তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি মহা বিস্ফোরণে সমস্ত কিছু শুরু হল।

“সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ্ আসমান ও জমীন সৃষ্টি করলেন।” (১ আয়াত)

পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থা (৪৫০ কোটি বছর আগে) আধুনিক বিজ্ঞানের মতে প্রথমে পৃথিবীর চারদিকে এতো বেশী আন্তঃগ্রহ ধূলিকণা ছিল যে পৃথিবীর তলের অবস্থা পুরোপুরি অন্ধকার ও বিশৃঙ্খল ছিল। এই তথ্য পয়দায়েশ ১:১-২ বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়:

“দুনিয়ার উপরটা তখনও কোন বিশেষ আকার পায় নি, আর তার মধ্যে জীবন্ত কিছুই ছিল না; তার উপরে ছিল অন্ধকারে ঢাকা গভীর পানি। আল্লাহ্‌র রূহ্ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন।” (২ আয়াত)

বিশৃঙ্খলের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার ধাপগুলো :

প্রথম ধাপ:পৃথিবীর তলে দিনরাত উপলব্ধি
(৪৫০-৩০০ কোটি বছর আগে)
আন্তঃগ্রহ ধূলিকণা আংশিক ভাবে অপসারণহয় এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আংশিক ভাবে রূপান্তর হয় যেন মহাকাশের আলো ঢুকে সমুদ্রের তলে দেখা দেয়।

প্রথম ‘ইয়ম’: “…আল্লাহ্ বললেন, “আলো হোক।” আর তাতে আলো হল। তিনি দেখলেন তা চমৎকার হয়েছে। তিনি অন্ধকার থেকে আলোকে আলাদা করে আলোর নাম দিলেন দিন আর অন্ধকারের নাম দিলেন রাত। এইভাবে সন্ধ্যাও গেল আর সকালও গেল, আর সেটাই ছিল প্রথম দিন।” (৩-৫ আয়াত)

দ্বিতীয় ধাপ: সমুদ্র-বায়ুমণ্ডল পৃথক হয়ে যাওয়া
(৩০০-২০০ কোটি বছর আগে)
বায়ূমণ্ডলের ক্রান্তি মন্ডলে (troposphere) বাষ্প গঠন হয় যেন স্থিতিশীল পানির চক্র প্রতিষ্ঠিত হয়

দ্বিতীয় ‘ইয়ম’: “…তারপর আল্লাহ্ বললেন, “পানির মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গার সৃষ্টি হোক, আর তাতে পানি দু’ভাগ হয়ে যাক…” (৬-৮ আয়াত)

তৃতীয় ধাপ: মহাদেশ ও সমুদ্র আলাদা, উদ্ভিদ
(২০০-৭০ কোটি বছর আগে)
মহাদেশগুলো ভাগ হয়ে সমুদ্র ও মহাদেশে আলাদা হয়ে যায়, এবং প্রথম উদ্ভিদ ও গাছ

তৃতীয় ‘ইয়ম’: “…এর পর আল্লাহ্ বললেন, “আসমানের নীচের সব পানি এক জায়গায় জমা হোক এবং শুকনা জায়গা দেখা দিক।” আর তা-ই হল। আল্লাহ্ সেই শুকনা জায়গার নাম দিলেন ভূমি, আর সেই জমা হওয়া পানির নাম দিলেন সমুদ্র।” (৯, ১০ আয়াত)

চতুর্থ ধাপ: বায়ুমণ্ডলের রূপান্তর – সূর্য, চাঁদ ও তারা দেখা যায়
(৭০-৬০ কোটি বছর আগে)
এর আগে বায়ুমণ্ডল আলোকপ্রবাহী ছিল কিন্তু অস্বচ্ছ, অর্থাৎ আলো ঢুকে যেত কিন্তু সূর্যচন্দ্র দেখা যেত না; এই ধাপে বায়ুমণ্ডল স্বচ্ছ হয় এবং সূর্যচন্দ্র স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

চতুর্থ ‘ইয়ম’: “…আল্লাহ্ দু’টা বড় আলো তৈরী করলেন (עשׂה – প্রকাশ করলেন)। তাদের মধ্যে বড়টিকে দিনের উপর রাজত্ব করবার জন্য, আর ছোটটিকে রাতের উপর রাজত্ব করবার জন্য তৈরী করলেন। তা ছাড়া তিনি তারাও তৈরী করলেন।” (১৬ আয়াত)

পঞ্চম ধাপ: পানির মধ্যে জীব, প্রাণী
(৬০-২০ কোটি বছর আগে)
ছোট সামুদ্রিক প্রাণী বিবর্তন হয়

পঞ্চম ‘ইয়ম’: “তারপর আল্লাহ্ বললেন, “পানি বিভিন্ন প্রাণীর ঝাঁকে ভরে উঠুক, আর দুনিয়ার উপরে আসমানের মধ্যে বিভিন্ন পাখী উড়ে বেড়াক।” (২০ আয়াত)

ষষ্ঠ ধাপ: স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং মানব জাতি
(২০-১ কোটি বছর আগে)
স্তন্যপ্রায়ী প্রাণীর বিবর্তন এবং homo sapien এর উত্থান।

ষষ্ঠ ‘ইয়ম’: “আল্লাহ্ দুনিয়ার সব রকমের বন্য, গৃহপালিত এবং বুকে-হাঁটা প্রাণী সৃষ্টি করলেন…পরে আল্লাহ্ তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন।” (২৫,২৭ আয়াত)

stages

কোরআন ও তৌরাত উভয় কিতাবেই আছে সমতুল্য কিছু রহস্যময় ঘটনার পর্যায়ক্রম। কোরআন শরীফের প্রধান সৃষ্টি-বর্ণনা সূরা ৪১:৯-১২ আয়াত অনুযায়ী, সাতটি আসমানের সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সৃষ্টির পরে, যদিও বর্তমান বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী আসমান সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর সৃষ্টির কোটি কোটি বছর পূর্বে। সূরা বাকারাহ্‌ ২৯ আয়াতে একই কথা বলা হয়েছে—

“তিনি পৃথিবীর সব কিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন, তৎপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং উহাকে সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন।” (বাকারাহ্‌ ২৮)

তাহলে কোরআনের মধ্যেও আমরা এমন কালানুক্রমিক জটিলতা দেখতে পাই। তার মানে এই নয়, যে কোরআন ভুল, বরং আমরা দেখি যে সব কিতাবের মধ্যে কিছু জটিল বিষয় থাকে।

কিছু সমালোচক বলেন যে চতুর্থ দিনে সূর্য, চন্দ্র ও তারার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শব্দটি হলো ‘তৈরী করা’, ‘দৃশ্যমান করা’ নয়। আসলে কিন্তু, এখানে হিব্রু “সৃষ্টি” বা “তৈরী” শব্দটি ব্যবহার হয় নি (בּרא, বারা), বরং עשׂה (‛আসাহ্‌) শব্দ ব্যবহার হয়েছে এখানে, যার অর্থ হতে পারে “দৃশ্যমান করা।” এই শব্দটি হিব্রু কিতাবে ১২০০ বার ব্যবহার করা হয়েছে এবং অনেক ধরনের মানে বহন করে, যাদের মধ্যে “করা”, “তৈরি করা”, “দেখানো”, “আবির্ভাব”, “আবির্ভূত করা” ইত্যাদি। এই যুক্তির আলোকে আমরা অবশ্যই এই বলে শেষ করতে পারি যে সূর্য এবং চাঁদ প্রথম দিনে সৃষ্টি (৩য় আয়াত) হয়ে থাকলেও, চতুর্থ দিনে সূর্য এবং চাঁদ পৃথিবীর তলে দৃশ্যমান হয়।


১.

পয়দায়েশ ১:১১-১৩–“সূর্য সৃষ্টি হওয়ার আগে কীভাবে গাছ-পালা থাকতে পারে?”

পয়দায়েশ ১:১১-১৩–“সূর্য সৃষ্টি হওয়ার আগে কীভাবে গাছ-পালা থাকতে পারে?”

জাকির নায়েক তৌরাতের বর্ণনা সমালোচনা করে বলেন যে সূর্য সৃষ্টির আগে গাছপালা সৃষ্টি করা অসম্ভব। উপরের বর্ণনায় সমস্যা সমাধান হলেও, আমরা সহীহ্‌ হাদিস ও আল-তাবারীর বিবরণে একই জিনিস দেখি যে, সেখানেও সূর্য সৃষ্টির দুই দিন আগেই গাছপালা সৃষ্টি হয়েছে। উপরোক্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকে জানা যায় যে উদ্ভিদের বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে বায়ূমণ্ডল দিয়ে আলো আসতো কিন্তু পৃথিবীর তল থেকে সূর্য দেখা যেত না। চতুর্থ দিনে বায়ুমন্ডল স্বচ্ছ হয়ে সূর্য ও চাঁদ দৃশ্যমান হয়। এই আংশিক আলোতে সালোকসংশ্লেষণ সম্ভব হয়ে উদ্ভিদের বিবর্তন হয়, যার বৃদ্ধির ফলে অক্সিজেনযুক্তকরণ হয় যেন বায়ূমণ্ডল পরিষ্কার ও স্বচ্ছ হয়। ডঃ রবার্ট সি নিউম্যান (কোর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে পি.এইচ.ডি.…